সিপিডির গবেষণার তথ্য

ব্যাংকে টাকা রেখে ৪ বছর ক্ষতির শিকার মানুষ

স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আহ্বান

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ব্যাংকে টাকা রেখে দেশের আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির গতির সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যাংকে রাখা আমানতের সুদহার বাড়েনি। এতে করে মানুষ মুনাফা তো পাচ্ছেই না, উল্টো ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আগে পলিসি ঠিক করে কঠোর সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তা না হলে দেশে বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) করা এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে 'বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সামনে কী' শীর্ষক এক সেমিনারে ওই গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সংস্থার সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন। এতে সাবেক পরিকল্পমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাসহ হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৫ অনেকে অংশগ্রহণ করেন। ক্ষতির মুখে ৪ বছর ধরে :সিপিডি বলছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে ব্যাংকে টাকা রেখে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ প্রায় চার বছর ধরে ব্যাংকে আমানত রেখে মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৫ হচ্ছে। ব্যাংকে আমানত রেখে সর্বশেষ মুনাফা পাওয়া গেছে ওই বছরের ফেব্রম্নয়ারি মাসে। পরের মাস মার্চে আমানতের প্রকৃত সুদহার ছিল শূন্য। সিপিডির হিসাব মতে, ২০২০ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে ব্যাংক আমানতের প্রকৃত সুদহার ছিল শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। মার্চে তা শূন্যের কোটায় নামার পর ২০২৪ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকৃত সুদহার ঋণাত্মক। ২০২২ সালের আগস্ট ও ২০২৩ সালের মে মাসে তা সর্বোচ্চ মাইনাস ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত নেমেছিল। এরপর মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে তা সব সময় ওঠানামা করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে আমানতের সুদহার ছিল মাইনাস ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সুদহার ৬-৯ করার পর ঋণের সুদহারের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও কমে গিয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৮ আগস্ট মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বলা হয়, আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। কিন্তু অনেক ব্যাংকই তা দিতে পারেনি। এরপর ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া হয় এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমানতের সুদহারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়। এরপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়িয়েছে। এখন আবার অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করতে সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু সিপিডির এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে- প্রায় চার বছর ধরে মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে ক্ষতির মুখে পড়ছে। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া খেলাপি ঋণের তথ্যের সঙ্গে সিপিডির চিত্র মিলছে না। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের যে হিসাব প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে পুনঃতফসিল, অবলোপন ও অর্থঋণ আদালতের হিসাব যোগ করলে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, সরাসরি খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৪৫ লাখ ৪৩৩ কোটি টাকা। এর বাইরে রাইট অফ বা অবলোপন, পুনঃতফসিলিসহ মন্দ ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা আটকে আছে। সব মিলিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের অংক দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, '২০২২ সালের শেষে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে অর্থঋণ আদালতের মামলায় আটকে থাকা এক লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খারাপ ঋণ আরও বেশি।' 'স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক' ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে যথাসময়ে (রিয়েল টাইম) তথ্য দেওয়া হয়। যে কারণে তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা থাকে। অথচ আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটা করছে না। এখানে যথাসময় তথ্য নিশ্চিত না করে উল্টো তথ্য সংগ্রহের দরজা বন্ধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাইরের চাপে বা নিজেরা ইচ্ছা করে স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। এই অবস্থার থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।' তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক তারা নিজেরা স্বাধীন বলা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের অধীনস্থ করা হচ্ছে বা কাজ করতে হচ্ছে অথচ তারা স্বাধীন। এই অবস্থায় ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফেরাতে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। যারা ব্যাংকের সার্বিক স্বাস্থ্য দেখবে এবং তুলে ধরবে। তবে কেবল কমিশন গঠন করলেই হবে না, স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকতে হবে কমিশনের। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটার সফলতার মুখ দেখেনি।' তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চরম অবনতি হয়েছে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাংক খাতে অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। এ প্রবণতা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করছে।' সবার আগে দরকার অডিটের মাধ্যমে সংকট খতিয়ে দেখা দুর্বল ও সবল ব্যাংকে একীভূত প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, সরকারি ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার থেকে বহুবার অর্থ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে বার বার দেওয়া হচ্ছে। শুধু বেসরকারি ব্যাংক যেমন- পদ্মা ব্যাংককে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সেটা রক্ষা হয়নি। এরূপ অবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যদি নিতেই হয় তাহলে পৃথিবীর স্বনামধন্য অ্যাসেসমেন্ট কোম্পানিকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়ে আসুন। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকিং 'স্বাস্থ্য' সেটা বিবেচনায় নিলে তারা আগ্রহী হবে কিনা- সেটা বড় প্রশ্ন। আর মার্জ করার বিষয়ে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কিনা? সবার আগে দুর্বল ব্যাংকের স্বাস্থ্য অডিটের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা দরকার, সেটা আসলে কতখানি খারাপ। তারপরও ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেবে যে, ভালো ব্যাংকগুলো ওই ব্যাংক কিনবে কিনা? 'প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত' প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'এই অবস্থা থেকে যদি ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলতে হয়ে তাহলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বিগত দিনে আমরা দেখেছি, লাভের ব্যক্তিকরণ এবং ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সুদহার, ডলারের দর অনেক আগেই বাড়ানো দরকার ছিল। তা না করায় মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, ডলারের দর বাড়িয়ে কিংবা সুদহার বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি হবে না।' তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্তের জন্য ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদকে ডাকে। সকালে সিদ্ধান্ত নেয় বিকালে পরিবর্তন করে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমবায় সমিতিতে পরিণত হয়েছে।' ড. সালেহউদ্দিন বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। আমরাও চালিয়েছি, এত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিনি, এত সার্কুলার দেইনি। এখন কেউ খেলাপি হলে তার একটি প্রতিষ্ঠান ঋণ পাবে না, তবে অন্যগুলো পাবে- এটা কী, আমার বুঝে আসে না। আমরা রিজার্ভ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলে এখন মাথায় হাত। আমাদের পলিসিটা আগে ঠিক করতে হবে, কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।' তিনি বলেন, 'এখন ব্যবসার মতোই খেলাপি ঋণ মডেলে পরিণত হয়েছে। সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক চাপের কারণে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এত খারাপ অবস্থায় আগে কখনো যায়নি। এ অবস্থায় অবশ্যই কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সুশাসন আনতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতই ক্যাশলেস সোসাইটি, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, কলিংপেগ দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করতে চায় সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না।'