শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার কলকাতায় খুন

দেশে তিনজন গ্রেপ্তার
তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
  ২৩ মে ২০২৪, ০০:০০
আনোয়ারুল আজিম আনার

দেশে বসে কিলিং মিশনের নিশ্ছিদ্র ছক সাজিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনস নামের একটি অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া এক নারীসহ অন্তত ৫ জন বাংলাদেশি কিলার হত্যাকান্ড ঘটানোর পরপরই দেশে ফিরে আসে। কিলার গ্রম্নপের আরেক সদস্য ভারতে আত্মগোপন করে থাকতে পারে। এদের মধ্যে তিনজনকে বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আনোয়ারুল আজিম ভারতে নিখোঁজ হওয়ার আট দিনের মাথায় সেখানকার গোয়েন্দারা এসব তথ্য দেন। তবে খুনের আলামত পাওয়া গেলেও সাংসদ আনারের মরদেহ উদ্ধার হয়নি বলে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। ফলে তার মৃতু্য এবং মৃতদেহ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। যদিও এরইমধ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ কিলিং মিশনে জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ তিনজনকে আটক করেছে। তাদের কাছ থেকে হত্যাকান্ড সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে গোয়েন্দারা দাবি করেছেন। এদিকে বুধবার বিকালে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনস থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আইজি সিআইডি অখিলেশ চতুর্বেদী জানান, 'এখন পর্যন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়নি। আমরা তদন্ত শুরু করেছি। আমাদের কাছে যা তথ্য রয়েছে, তাতে ১৩ তারিখে তিনি এই ভবনে ঢুকেছিলেন। তবে এর আগে এসেছিলেন কি না সেটি আমরা জানি না। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। যদিও বিষয়টি এখনো তদন্তসাপেক্ষ।' মরদেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে বলে এর আগে যে খবর ছড়িয়েছে সে ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এটি এখনই বলা সম্ভব নয়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফটোগ্রাফি- সব টিমকে এই তদন্তে ইনভাইট করা হয়েছে। বিষয়গুলো তারা খতিয়ে দেখছেন।' এদিকে ভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলকাতার যে ফ্ল্যাটে এমপি আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে, সেখানে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। ওই সংবাদে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে। আনোয়ারুল আজীমকে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের যে অ্যাপার্টমেন্টে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল, সেখানে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে তার লাশ পাওয়া যায়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সূত্র দিয়ে ভারতীয় একটি গণমাধ্যম এর আগে জানিয়েছিল, নিউটাউনের এক অভিজাত আবাসন থেকে আনোয়ারুল আজীম আনারের লাশ উদ্ধার করা হয়। যদিও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। বিকালের দিকে ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে সেখানকার গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, বিধাননগরের নিউটাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে চারটি ট্রলি ব্যাগে করে টুকরো টুকরো মরদেহ গায়েব করা হয়েছে। পুলিশ বর্তমানে সেই ব্যাগগুলোর সন্ধান করছে। ভারতে আনারের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দুই দেশের পুলিশ একসঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের আইজি চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুন। তিনি বলেন, 'এমপি আনার জীবিত নাকি মৃত তা এখনো অফিসিয়ালি নিশ্চিত নই। আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। তদন্তের স্বার্থে ইন্ডিয়ান পুলিশ আমাদের কাছে যে ধরনের সহযোগিতা চাইছে তা আমরা দিচ্ছি।' তবে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের জানান, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ বাংলাদেশের সাংসদ আনারের মরদেহ কলকাতার নিউটাউন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আনার হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ধরতে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের পুলিশ কাজ করছে। হারুন অর রশীদ আরও বলেন, 'আমরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাছে কয়েকজন আছে। আমরা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তাদের কাছ থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তবে তদন্তের স্বার্থে আমরা এখনই সবকিছু বলতে চাচ্ছি না। বাকি যারা রয়েছে সবাইকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব এবং বিচারের মুখোমুখি করব।' হত্যাকারী কোন দেশের তা জানতে চাইলে তদন্তের স্বার্থে তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন ডিবির এই কর্মকর্তা। এদিকে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় এই সাংসদকে কেন দেশ থেকে ভারতে নিয়ে খুন করা হলো, এর নেপথ্যে কারা এবং হত্যাকান্ডের মোটিভই বা কি- তা নিয়ে রহস্যজট সৃষ্টি হয়েছে। নৃশংস এই খুনের নেপথ্যে রাজনৈতিক অথবা ব্যবসায়িক বিরোধ থাকতে পারে বলে স্থানীয়রা অনেকেই অনুমান করছেন। প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট নিয়ে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হতে পারে বলেও একটি ক্লু পাওয়া গেছে। এমপি আজিমের স্বজনদের ধারণা, রাজনৈতিক বিরোধের জের ধরেই তিনি প্রথমে নিখোঁজ হন। এরপর প্রতিপক্ষরা পরিকল্পিতভাবে তাকে ভারতে নিয়ে হত্যা করে থাকতে পারে। এমপির বড় ভাই এনামুল হক ইমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তারা গোয়েন্দা পুলিশের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে, নিখোঁজের আগে এমপি আজিম গত ১৬ মে সকালে স্থানীয় এক নেতাকে ফোন করেছিলেন। তবে তারা বিস্মিত হয়েছিলেন যে, সেই নেতার সঙ্গে আজিমের এতটাই বিরোধ ছিল যে তাকে ফোন করার কথা নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আজিমের ফোন থেকে কারা সেই নেতাকে ফোন করেছিল। এনামুল হকের মতে, যেহেতু ভারত থেকে সেই নেতাকে তার ভাই ফোন করেছিলেন, তাই তার ভাই সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন তার সামনে বিপদ। হয়তো প্রাণভিক্ষার জন্য ফোনটা দিয়েছিল। এদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, ভারতে যাওয়ার পর এমপি আনারের মোবাইল ফোন সিমের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান পাওয়া গেছে। তার অবস্থান কখনো মোজাফফরাবাদ, কখনো বেনাপোলের কাছাকাছি আবার কখনো কলকাতা দেখা গেছে। আসলে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কারা তার ফোন ব্যবহার করে কথা বলেছিল, কার কার সঙ্গে কথা বলেছিল সেসব নিয়ে রহস্যের জট তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, এমপি আনার ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার অন্তর্গত মন্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে পরিচিত এক ব্যক্তির বাড়িতে ওঠেন। পরের দিন ১৩ মে দুপুরে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ১৫ মে বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাসের হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ করে জানান তিনি দিলিস্ন যাচ্ছেন। গত ১৬ মে সকাল ৭টা ৪৬ মিনিটে এমপির ফোন থেকে পিএস রউফের নম্বরে সর্বশেষ কল আসে। কলটি রিসিভ করতে পারেননি পিএস। এক মিনিট পর পিএস তাকে কল করলে ওপাশ থেকে রিসিভ হয়নি। এরপর থেকে আনারের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই পরিবারের সদস্যদের। একইদিন এমপির ব্যক্তিগত গাড়ি চালক তরিকুল ইসলাম ও পিএস আব্দুর রউফের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একটি ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানান দিলিস্ন যাওয়ার কথা। এরপর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর থেকে পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তাকে ফোনে বা কোনো মাধ্যমে না পেয়ে বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জানান উদ্বিগ্ন এমপির পরিবার। এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ১৮ মে থানায় একটি মিসিং ডায়েরি করেন ভারতের বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস। যার বাসায় উঠেছিলেন এমপি আনার। এরপর থেকে নড়েচড়ে বসে দুই দেশের পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী। গোপাল বিশ্বাস জানিয়েছেন, ১৩ মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে ভাড়া করা গাড়িতে উঠেছিলেন এমপি আনার, সেটির চালকের সন্ধান পেয়েছে বলেই স্থানীয় পুলিশের তরফে তাকে জানানো হয়েছে। 'পুলিশের কাছে আমি নিখোঁজের ডায়েরি করেছিলাম। তারা ওই গাড়িটিকে খুঁজে বের করেছে আর চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই চালক নাকি পুলিশকে জানিয়েছেন যে সংসদ সদস্যের সঙ্গে একজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। এদের দু'জনকে তিনি কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউন এলাকায় ছেড়ে দেন ১৩ মে'- জানান গোপাল বিশ্বাস। বিষয়টি স্বীকার করে কলকাতা বিধাননগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেন, 'জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাবচালক জানিয়েছে ১৩ মে যে ব্যক্তিকে সে গাড়িতে তুলেছিল তাকে এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপেস্নক্স নামিয়ে দেয়।' \হসেখানকার এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটের ভেতরেই হত্যাকান্ড ঘটেছে। সেখানে রক্তের দাগ ও অন্যান্য প্রমাণ রয়েছে। ১৩ মে ওই এমপির সঙ্গে তিনজন সেখানে ঢুকেছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তারা একেকজন পৃথক পৃথকভাবে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হয়েছেন। ১৫ মে একজন, ১৬ মে আরেকজন এবং ১৭ মে আরেকজন বের হয়েছেন সেখান থেকে। তিন জনের মধ্যে একজন মহিলাও ছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দাদের অপর একটি সূত্র জানায়, ১৩ মে দুপুরের পর এমপি আনারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিউটাউনের অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনে। সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন দুই পুরুষ ও এক নারী। তারা চারজনেই ওঠেন আবাসনের বি ইউ বস্নকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে। \হসেখানে রক্তের দাগ ও একাধিক পায়ের চিহ্ন দেখে গোয়েন্দাদের অনুমান, ওই রাতে চারজন একসঙ্গেই ছিলেন। এরপর সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। পরে লাগেজে করে মরদেহের টুকরো বের করে নেয় খুনিরা। এ কাজ করতে সময় লাগে তিন দিন। তারা পরিকল্পিতভাবে প্রতিদিনই লাগেজ নিয়ে একজন করে বের হয়েছে। পুলিশের অনুমান, প্রথমে বের হন ওই নারী। এ ঘটনায় দু'জনকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ। তবে কারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা বাংলাদেশি নাকি ভারতীয় এ নিয়ে পুলিশ মুখ খোলেনি।

পুলিশ জানায়, ওই ফ্ল্যাটের মালিক সন্দীপ রায়। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি বিভাগে রয়েছেন। অথচ তিনি ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছিলেন, আখতারুজ্জামান নামে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক বাংলাদেশিকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওই বাংলাদেশি কোথায়? পুলিশ বলছে, এখনই এ নিয়ে কোনো তথ্য দেব না। তবে পুলিশ নিশ্চিত, এটি নিখোঁজের ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। এখন ফ্ল্যাটে ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

এদিকে সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস (ডরিন) বুধবার দুপুরে ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বাবার হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে তিনি কারা তাকে এতিম করেছে, তাদের দেখতে চান।

মুমতারিন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে একটা বড় সময় বাবাকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় তিনি ১৪ বছর লুকিয়ে ছিলেন। তখন আমি ছোট। তখন আমার বাবাকে কাছে পাইনি। যখন আমার একটু বুঝ হয়েছে, তখন আমার বাবাকে কাছে পেয়েছি। এখন আমি বাবাকে হারিয়ে ফেললাম।’

বাবার হত্যাকারী হিসেবে কাউকে সন্দেহ করেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মুমতারিন বলেন, ‘আমি চিনি না। কিন্তু আমি চিনতে চাই। ডিবি প্রধানকে বলতে চাই, আপনি চিহ্নিত করেন।’

আনোয়ারুল আজিম ভারতে যাওয়ার আগে শেষবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানান মুমতারিন ফেরদৌস। সেই কথোপকথনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সে বলে, “আম্মু আমি ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি, দুই দিনের মধ্যে চলে আসব। তোমার দাঁতের ডাক্তার দেখানোর কথা, দুই দাঁতে সমস্যা। তোমাকে আমি নিয়ে যাব, তুমি যেয়ো না। তোমার ডাক্তার ফোন করলে বলবে, আব্বু ইন্ডিয়া থেকে এসে নিয়ে যাবে। তুমি থাকো। আমি আসি।’ এ কথা বলে গেছে আমাকে। তারপর আমার সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি।’

নিজের পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি জানিয়ে মুমতারিন ফেরদৌস বলেন, ‘বাবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমাকে এখানে (ঢাকা) পড়ার জন্য ভর্তি করেছে। আমি পরীক্ষাও দিয়েছি। সামনে রেজাল্ট দেবে। সে বলে গেছে, ‘আমি ভারত থেকে এসে তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট চেক করব।’

কিন্তু বাবা তার কথা রাখতে পারলেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এতিম হয়ে গেছি। যার বাপ থাকে না, তার কেউ থাকে না। তারা এতিম হয়ে যায়। যতই কাছের আত্মীয়, আপন মানুষ যে-ই থাকুক, বাবা বাবাই। বাবার মতো কেউ হয় না।’

এ ঘটনায় জড়িত বাকি ব্যক্তিদেরও গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়ে মুমতারিন ফেরদৌস বলেন, ‘আসামি কিছু ধরা হয়েছে। আরও কিছু ধরার প্রক্রিয়া চলছে। আমি তাদের ধরতে বলেছি। তাদের ধরুক। তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনো কিছু বেরিয়ে আসবে।’

প্রতিবেশী দেশের পার্লামেন্টারিয়ান আনোয়ারুল আজিম ভারতে চিকিৎসা করাতে এসে যেরকম দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা গেছেন, তাতে দিল্লিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তদন্ত শেষ না হলে এবং পুলিশ সব বিস্তারিত না জানালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনই কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে চাইছে না।

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র অবশ্য নিশ্চিত করেছেন, এমপি আজিম যে কলকাতায় আসার পর হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছেন- বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সেটা তাদের জানানোর পর থেকেই তাকে খুঁজে বের করার সব ধরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছিল। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দারাও এ ব্যাপারে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন।

বস্তুত, আনোয়ারুল আজিম কলকাতায় এসে যে ভারতীয় সিমকার্ডটি ব্যবহার করছিলেন, সেটি যে ১৭ মে খুব অল্প সময়ের জন্য বিহারের মুজাফফরপুরের কাছে চালু করা হয়েছিল- সেই তথ্যও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা ট্র্যাক করে বের করেছিলেন। পরে কলকাতায় বাংলাদেশের উপদূতাবাসের মারফত সেই খবর ঢাকায় তদন্তকারীদের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়।

আনোয়ারুল আজিমকে ঠিক কী পরিস্থিতিতে, কীভাবে, আর কেন হত্যা করা হয়েছে (যদি এটা হত্যাই হয়ে থাকে) তা নিয়ে যেহেতু এখনো অনেক অস্পষ্টতা আছে, তাই সরকারিভাবে ভারত এটা নিয়ে এখনই কোনোও মন্তব্য করতে চাইছে না। দিল্লির নর্থ ব্লকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে সাংবাদিকরা এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি শুধু জানিয়েছেন, ‘এই বিষয়ে যা বলার পশ্চিমবঙ্গের (বিধাননগর) পুলিশই বলবে।’

তবে তদন্তকারী দলের পক্ষ থেকে এটুকু আভাস দেওয়া হয়েছে, এমপি আনোয়ারুল আজিমকে যারাই হত্যা করে থাকুক, এই হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশেরই বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা পাওয়া গেছে।

‘একজন বিদেশি এমপি কলকাতায় এসেছেন, আর তার সঙ্গে পয়সাকড়ি আছে এটা আঁচ করে স্থানীয় কোনো অপরাধী চক্র বা দুষ্কৃতকারী গ্যাং তাকে মেরে ফেলে টাকাপয়সা লুট করতে চেয়েছিল- ব্যাপারটা অত সহজ নয় বলেই ধারণা করছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। তাদের ভাষ্য, এই হত্যারহস্য আসলেই খুব জটিল এবং এর পুরো কিনারা করতে বেশ সময় লাগতে পারে।

আনোয়ারুল আজিম আনারের জন্ম ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে ঝিনাইদহ জেলায়। তিনি ব্যবসা ও কৃষি কাজের পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তিনি ২০০৯ সালে কালীগঞ্জ উপজেলার উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম জাতীয় সংসদে তিনি নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে দুই কন্যা সন্তানের জনক।

আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যার খবরে কালীগঞ্জে তার বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ের সামনে আত্মীয়স্বজন, নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের জড়ো হতে দেখা গেছে। অনেকের আহাজারিতে পুরো এলাকায় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দলীয় নেতাকর্মীরা এমপি আনার হত্যার রহস্য উদঘাটনের দাবি জানান।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, ‘এমপির এমন মৃত্যু মর্মান্তিক, আমরা শোকাহত। তার মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করে ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।’

এমপির নির্বাচনী এলাকা কালীগঞ্জ উপজেলার ১নং সুন্দরপুর দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু বলেন, ‘গণমাধ্যমে আমরা তার মৃত্যু সংবাদ শুনে রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে এসেছি। তার মৃতদেহ ভারতে পাওয়া গেছে শুনেছি। কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা বলতে পারছি না। এমপির সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ ছিল না। যা ছিল তা খুবই সামান্য কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। তার পরিবার ঢাকাতে অবস্থান করছেন। তারা আসলে আরও কিছু জানা যাবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে এমপির মরদেহ দেশে আনা হবে। আমরা এখন মরদেহের জন্য অপেক্ষা করছি।’

এমপির এক শাশুড়ি কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমাদের সোনার জামাই কীভাবে চলে গেল। তার টাকা পয়সা সব কিছু নিয়ে যেত, আমাদের জামাইকে ফিরিয়ে দিত। কেন এভাবে নিয়ে গেল। সে তো কাউকে ক্ষতি করেনি। তাকে কেন মেরে ফেলা হলো। আমরা এর বিচার চাই।’

আনারের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সিঁড়িতে বসে বিলাপ করছিলেন এমপি আনারের এক সহযোগী রুবেল হোসেন। তিনি বলেন ভারত যাওয়ার আগে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়। তিনি বলেছিলেন চেকগুলো তুলে রাখ। গরিব মানুষের চেকগুলো তুলে রাখ। আমি ফিরে এসে চেকগুলো সব একসাথে বিতরণ করবো। সে চলে গেল, এখন এভাবে কে গরিব মানুষের নিয়ে ভাববে। কে আর এভাবে কথা করবে।

এদিকে এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। বুধবার রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। সন্ধ্যায় শেরে-বাংলা নগর থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহাদ আলী। তিনি বলেন, মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হকও মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে ডরিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে