অপরিকল্পিত নগরায়ণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য

বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস আজ

প্রকাশ | ২২ মে ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
প্রতিনিয়ত কমছে দেশের বনভূমির আকার। বিপুল জনসংখ্যার বসবাসের স্থান তৈরি ও শিল্প খাত গ্রাস করছে কৃষি জমি, কমছে খাদ্য উৎপাদন। অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে নদীতে দেওয়া বাঁধ, অবৈধ বালু উত্তোলনে বদলে যাচ্ছে গতিপথ; শহর ঢেকে যাচ্ছে কংক্রিটে, নেই জলাধার, বাড়ছে তাপমাত্রা। সব মিলিয়ে গভীর সংকটে দেশের জীববৈচিত্র্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের অসচেতনতা ও দখলদারিত্ব এই সংকটের অন্যতম কারণ। যার তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের পরিবেশর ওপর। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস'। প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলাদেশে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালিত হচ্ছে। মূলত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতেই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু গত দুই দশকে পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে মানবসৃষ্ট নানা কারণ। যা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ, ২ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে। আর বন বিভাগের হিসাবে সারাদেশে দখল হয়ে গেছে প্রায় তিন লাখ একর বনভূমি। এদিকে চলতি গ্রীষ্মে প্রচন্ড তাপদাহে পুড়ছে গোটা দেশে। এ ছাড়াও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তীব্রভাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণেই পরিস্থিতি এমন হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখতে পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ উন্নয়ন-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রতিপালন রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে দেশের কৃষি অগ্রযাত্রাকে সুষ্ঠুভাবে ত্বরান্বিত করতে জীববৈচিত্র্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও মানুষকে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রকৃতি ধ্বংসের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে, তা যদি চলতে থাকে, তাহলে ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। আর সে হিসাবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০-১০০ গুণ বেশি। পৃথিবীব্যাপী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভগুলো মনুষ্য কর্মকান্ডে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূ-ভাগে মানুষ ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ বর্তমানে পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। এদিকে ২০১০-২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি পরিবেশগত এই অবক্ষয় রোধ না করা যায়, তাহলে ব্যাপকভাবে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অতিরিক্ত জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ ৬০ ভাগ জ্বালানির চাহিদা পূরণ করছে বনের কাঠ দিয়ে। এ ছাড়াও বসতবাড়ি নির্মাণ, ফসল চাষাবাদ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নগরায়ণ, জুমচাষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃক্ষের পরিচর্যার অভাব, পরিবেশ দূষণ, পাহাড় কাটা, পাহাড় ধ্বংস, বৃক্ষের রোগ, বনবিধি অমান্য করাসহ বিভিন্ন কারণে বন ধ্বংস হচ্ছে। এদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর জন্ম, বিচরণ, প্রজনন ও বসবাসের সংকট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইইউসিএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈরী জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে ৭০৮ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টি, ৬৩২ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং ৩০ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ৪৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে ৮টি, ১৬৭ সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যে ১৭টি বিলুপ্তির পথে। ১২৭টি স্তন্যপাখী প্রজাতির মধ্যে ১২টি বিপণ্ন আর ১৭টি বিলুপ্তির পথে। ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১০৬টি অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এ ছাড়াও প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ৫০টি বাঘ কমে যাচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাসমূহের বাজেটে সুনির্দিষ্ট আর্থিক বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত করে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।