বিলুপ্ত হতে পারে পা চালিত রিকশা

প্রকাশ | ২২ মে ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
রাজধানীর সড়কে পা চালিত রিকশা -ফাইল ছবি
দেশ থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে প্যাডেল রিকশা। যদিও ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই বাহনটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ঢাকায় দাপটের সঙ্গেই টিকে আছে বাহনটি। সবশেষ রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেন এসব যানবাহনের চালক ও মালিকরা। বিক্ষোভকালে রাস্তা অবরোধ, যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে ঢাকায় নির্ধারিত রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দেন। পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা এবং পা চালিত রিকশার চালকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকেই ঢাকার পাড়া মহলস্না ও অলি-গলিতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। শুধু রিকশা নয়, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ইজিবাইক। স্বাভাবিক কারণেই কমে গেছে পা চালিত রিকশার সংখ্যা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা থেকে পা চালিত রিকশা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুরোপুরি যানজটের নগরীতে পরিণত হতে পারে ঢাকা। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার আগারগাঁও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কের পাশে বিশ্রামরত পা চালিত এক রিকশা চালকের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা হয়। নিজের পরিচয় দেয়ার পর কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, 'আমার নাম রাশেদুল ইসলাম। বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর। পিতার নাম মোজাফফর আলী। মায়ের নাম \হরাশেদা বেগম। বাড়ি ঝিনাইদহ সদরে। মায়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রেখেছেন পিতা। তিন ভাই এক বোন। আমি তৃতীয়।' তিনি বলছিলেন, আট বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালাই। টাকা বাঁচানোর পাশাপাশি ঢাকার বেশিরভাগ সড়কে যাতায়াত করার সুবিধা থাকায় প্যাডেল রিকশা চালাই। কারণ ঢাকার ভিআইপি সড়ক ছাড়া সব রাস্তায় প্যাডেল রিকশা চলতে পারে। পুলিশ কোনো ধরনের বাধা দেয় না। যদিও পরিশ্রম অনেক। তারপরেও অনেক দিক থেকে সুবিধা বেশি। তিনি যে রিকশাটি ভাড়া নিয়েছেন সেটি ঢাকার আগারগাঁও ৬০ ফুটের একটি গ্যারেজের। প্রতিদিন রিকশা ভাড়া বাবদ দেড়শ' টাকা দিতে হয় রিকশা বা গ্যারেজ মালিককে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চালানো যায়। এরপর রিকশা গ্যারেজে জমা দিতে হয়। পা চালিত রিকশার পরিবর্তে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর বিষয়ে তিনি বলেন, একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার অনেক দাম। ব্যাটারিচালিত রিকশায় চারটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি থাকে। তার সঙ্গে থাকে একটি মটর। সেই মটরের সঙ্গে হ্যান্ডেলে সুইচ, লাইটসহ অন্যান্য জিনিসপত্র থাকে। একটি নতুন ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। এত দামের রিকশা চুরি হয়ে গেলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় গ্যারেজ বা রিকশা মালিককে। আর পায়ে চালিত রিকশার দাম তুলনামূলক অনেক কম। যদি নিতান্তই চুরি হয়ে যায়, তাহলে মালিককে অনুরোধ করে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিলেও চলে। আর পা চালিত রিকশা চুরি হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কারণ রিকশাটি খুব দ্রম্নত চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া চোরদের পক্ষে কঠিন। আর ব্যাটারিচালিত রিকশা চুরি হলে দ্রম্নত গতি চালিয়ে চোরেরা চলে যায়। ফলে তাদের ধরা যায় না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু অনুমতি দিয়েছেন, এখন মূল রাস্তায়ও তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলবে। তবে কিছুটা সময় দেরি হতে পারে। কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো যে এলাকার সেসব এলাকার স্থানীয় নেতাসহ প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা টাকা ছাড়া মূল সড়কে চালানো যায় না। সব কিছু ম্যানেজ করে চালাতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির পরেও ব্যাপকহারে রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দিচ্ছেন না স্থানীয় নেতা ও প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞার পর রেট বেড়ে গেছে। রেট নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। সমঝোতা হওয়ার পরেই রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নেমে আসবে। তিনি বলেন, ঢাকায় এক সময় প্যাডেল রিকশা থাকবে না। কারণ প্যাডেল রিকশা আর ব্যাটারিচালিত রিকশার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। হঠাৎ করে দেখে বুঝার উপায় নেই, কোনটি প্যাডেল রিকশা, আর কোনটি ব্যাটারিচালিত রিকশা। কারণ রিকশার কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। শুধুমাত্র ব্যাটারিচালিত রিকশায় ব্যাটারি ও মটরের সঙ্গে অন্যান্য জিনিসপত্র থাকে। গাড়ির মতো চাবি দিয়ে অফ অন করে চালাতে হয়। পা দিয়ে চালানো রিকশার মতোই। তাই পা দিয়ে চালানো রিকশা যদি ভিআইপি সড়ক ছাড়া সব রাস্তায় চলতে পারে, তাহলে ব্যাটারিচালিত রিকশাও চলতে পারবে। তিনি বলছিলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার দিন হাজির অর্থাৎ রিকশার মালিককে দিনে ৩০০ টাকা জমা দিতে হয়। এর সঙ্গে রিকশার ব্যাটারির চার্জ বাবদ ৫০ টাকা বাড়তি দিতে হয়। সাড়ে ৩শ' টাকা দিলে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চালানো যাবে। এর মধ্যে ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে মালিক চার্জ করে দেবেন। প্রতিটি গ্যারেজেই চোরাই বিদু্যতের সংযোগে আছে। বিদু্যত অফিসের লোকজনের সঙ্গে লাইন করা গ্যারেজ মালিকদের। বিদু্যত অফিসের লোকজন বাড়তি টাকা পান। এতে করে বিদু্যতের অফিসের লোকজন ও গ্যারেজ মালিক দু'পক্ষই লাভবান হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে তেমন কোনো পরিশ্রম নেই। স্বাভাবিকভাবে ঢাকার যেসব রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে, সেইসব রাস্তায় চালালেও দৈনিক সব খরচ বাদ দিয়েও কমপক্ষে দেড় হাজার থেকে ২ হাজার টাকা রোজগার করা যায়। পা চালিত রিকশার জমা খরচের চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার জমা খরচ ডাবলের কিছুটা বেশি। তবে কম পরিশ্রমে রোজগার অনেক বেশি। তাই সামনের দিনগুলোতে পা চালিত রিকশা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাব। গ্যারেজ মালিকও সব পা চালিত রিকশায় ব্যাটারি ও মটর বসিয়ে ডিজিটাল রিকশা বানাবেন বলে জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (পুরকৌশল) বিভাগের শিক্ষক, সড়ক ও দুর্ঘটনা বিষয়ে দেশের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ব্যাটারিচালিত রিকশা যেসব এলাকায় গণপরিবহণ নেই বা চলে না এবং ঢাকার পাড়া-মহলস্নার রাস্তাগুলোতে চলাচল করতে পারবে। তবে সম্প্রতি দুই দিন ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের যে বিক্ষোভ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারকরাই দায়ী। কারণ এসব বাহন অনেক আগ থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এ ব্যাপারে অনেক আগেই সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। তাদের তদারকির অভাবে ঢাকায় লাখ লাখ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। অথচ এসব রিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। আস্তে আস্তে সমস্যা বড় হওয়ার পর তা সমাধান করার বা বন্ধ করার চেষ্টা করলে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল অনেক আগেই এ ধরনের যানবাহন আমদানি নিরুৎসাহিত করা। আমদানি করার অনুমতি দিয়ে বন্ধ করার প্রক্রিয়াটি কোনো পদ্ধতির মধ্যেই পড়ে না। তিনি আরও বলেন, এসব বাহনের সঙ্গে বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ ও পরিবারের কর্মসংস্থান জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই এটিকে এখন সহজেই আর নির্মূল করে ফেলা সম্ভব না। তবে নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে হবে। অন্যথায় ঢাকায় ঢালাওভাবে এ ধরনের বাহন চলাচল করতে থাকলে রাজধানী যানজটের নগরীতে পরিণত হবে। তাতে নূ্যনতম কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশের উচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এসব বাহনের সংখ্যা পরিমিত করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধররেন যানবাহন আছে। তবে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষ করে ইচ্ছা করলেও এসব যানবাহন ঢালাওভাবে কেউ বাড়াতে পারবেন না। অথচ আমাদের দেশে স্থানীয় নেতা, প্রশাসনের সমন্বয়ে রাতারাতি লাখ লাখ বাহন জন্ম নিচ্ছে। এমনকি আগামীতে পা চালিত রিকশাগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশায় পরিণত হবে। পা চালিত রিকশা চালাতে পরিশ্রম বেশি হওয়ায় এবং রোজগার কম হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে পা চালিত রিকশা। অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলছেন, এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তা অনেকাংশেই বাস্তবায়িত হবে না। সবার আগে উচিত দুই সিটি করপোরেশন, পুলিশ, বিআরটিএ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সঙ্গে সমন্বয় করে এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা। এসব যানবাহন ঢাকার রাস্তায় নামার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সিন্ডিকেট আছে। সেই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ঢাকার অবস্থা কি হবে, যেটা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। যানজটের সঙ্গে দুর্ঘটনা বাড়বে আশঙ্কাজনক হারে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।