বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শুভংকরের ফাঁকি

প্রকাশ | ২২ মে ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এই খাতে বরাদ্দ কমছে বছরের পর বছর। অথচ সরকার প্রতি বছর বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বৃদ্ধির কথা ফলাও করে প্রচার করলেও বরাদ্দের অর্থ বেশি ব্যয় হয় কৃষির উপখাতগুলোতে। বিশ্ব বাজারে ডিজেল বা সারের মূল্য বৃদ্ধি সমন্বয় করতে তখন কৃষি বরাদ্দের অর্থে হাত পড়ে। এ কারণে কৃষির উন্নয়নে অর্থের ঘাটতি তৈরি হলে থোক বরাদ্দের জন্য ধর্না দিতে হয়। এ যেন শুভংকরের ফাঁকি। কৃষি খাতে বাজেটের মোট বরাদ্দের অধিকাংশ অর্থ চলে যায় মৎস্য, প্রাণিসম্পদ পরিবেশ-জলবায়ু ও পানিসম্পদ খাতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে দশমিক ৩৩ ভাগ কমেছে। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৪৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতের জন্য রাখা হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এখান থেকে বাকি ২ দশমিক ৪১ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু, ভূমি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শতকরা ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। যা সারের ভর্তুকিতেই ব্যয় হয় অধিকাংশ অর্থ। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতের পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার ৪৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি বাজেট ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ও ভর্তুকি খাতে ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে হারে বাজেট বড় হচ্ছে, সেই হারে কৃষিতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ছে না। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাজেটে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকটে বিশ্বের অনেক দেশ চিন্তিত। উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং চলমান সংকটের কারণে বিশ্বে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ অত্যাসন্ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই বিশ্ব সর্বোচ্চ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করছে। কৃষি আবহমান বাংলার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের মূল চালিকাশক্তি। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন স্বনিভর্রতা অর্জনে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। মোট দেশজ উৎপাদনের হিসেবে জিডিপিতে এখন কৃষি খাতের অবদান ১৩ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৪১ শতাংশ। কৃষিপ্রধান দেশে বছরে মানুষের মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৩৪ কেজি। চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দৈনিক ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে। ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষিনির্ভর। দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তন, খরা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে কৃষিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন আসন্ন বাজেটে (২০২৪-২৫ অর্থবছর) কৃষিতে বরাদ্দ ৪০ শতাংশের বেশি হওয়া প্রয়োজন। গত শনিবার জাতীয় বাজেটের উন্নয়ন বরাদ্দের ৪০ শতাংশ কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্টের নেতারা। জাতীয় বাজেটের উন্নয়ন বরাদ্দের ৪০ শতাংশ কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন তারা। এদিকে উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করতে আগামী বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। কৃষিতে মোট বাজেটের ২৭ শতাংশ, জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন তারা। কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. আসাদুজ্জান মালিক বলেন, বিশ্বব্যাংক ও উন্নত বিশ্বের চাপে কৃষিতে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে এবং কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে এক করে বরাদ্দ বেশি দেখানো হচ্ছে। এ যেন কৃষি বরাদ্দ নিয়ে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে সার, বিদু্যৎ ও ডিজেলের মূল্য বাড়বে। এ জন্য এখন থেকেই কৃষিতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ানো দরকার। বিশ্বব্যাংকের কৃষিবিয়ক পরামর্শক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে কৃষিকে অবশ্যই আধুনিক কৃষি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যান্ত্রিকীকরণ, ডিজিটালাইজেশন এবং প্রযুক্তি সম্বলিত করতে 'স্মার্ট কৃষি বাজেট' করতে হবে। কৃষি উৎপাদনকে প্রাধান্য দিয়ে সার ও সেচকাজে বিদু্যতে ভর্তুকি বাড়তে হবে। বিনামূল্যে সার ও বীজ এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা দিতে হবে। কম করে হলেও মোট বাজেটের ১০ শতাংশ কৃষিতে বরাদ্দ দিতে হবে। এ বিষয়ে কৃষিবিদ ড. এম ফারুক তালুকদার বলেন, কয়েক বছর ধরে মূল বাজেট বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়ছে না কৃষি খাতের বাজেট। বাজেট উপস্থাপনার সময় কৃষি খাতে বরাদ্দ ও ভর্তুকির পরিমাণ বড় দেখানো হলেও। দিন শেষে কৃষির উপখাতগুলোতে বরাদ্দ ভাগ করে দেওয়ার পর কৃষিতে যৎসামান্য বরাদ্দ থাকে। সময় এসেছে, এখন উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। আগামী দিনে বিশ্বে তারাই টিকে থাকবে যাদের উৎপাদন বেশি। ডলার খরচ করে আমদানি করলেও বড় ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কৃষি বিষয়ক পরামর্শক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, বাজেটে কৃষি খাত এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ধানচাল, মৎস্য প্রাণিসম্পদ, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল আসে কৃষি খাত থেকে। খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাত করে এখন রপ্তানি হচ্ছে। এক সময়ের খাদ্য ঘাটতির দেশটি স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাতে দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হচ্ছে কৃষি খাত। কৃষিতে প্রণোদনার অর্থ বাড়ানো দরকার। জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। এ জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি খাত গড়ে তুলতে গবেষণায় বেশি জোর দিতে হবে। কৃষক ও বাজারের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, তা বন্ধ করতে কৃষি বাজার বাড়াতে হবে। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে কৃষকদের লাভবান করতে হবে।