সময়ের আগেই আসছে বর্ষা
প্রকাশ | ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এবার বর্ষা আসছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু স্বাভাবিক ছন্দেই এগোচ্ছে বলে মনে করেন আবহাওয়াবিদরা। এবার অবশ্য সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে জুন মাসের শুরুতেই বাংলাদেশে প্রবেশ করবে বর্ষা। রোববার আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করে বর্ষা। এবার আন্দামানে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রবেশ করেছে বর্ষা। সোমবার ভারতের কেরালা রাজ্য ও দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর এলাকায় বর্ষার বৃষ্টি প্রবেশ করেছে। এবার স্বস্তির বৃষ্টি নিয়ে আগেই আসছে বর্ষা জানিয়েছে বাংলাদেশ, জাপান ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর।
খনার বচনে আছে 'জৈষ্ঠ্যতে তারা ফোটে, তবে জানবে বর্ষা বটে। গাছে গাছে আগুন জ্বলে, বৃষ্টি হবে খনায় বলে।' বর্ষার আগমনে গর্জনে-বর্ষণে আকাশে মেঘদূতের ঘনকালো রূপ ধারণ করে। ষড়ঋতুর এ দেশে বর্ষা অনন্য, তার রূপের সৌন্দর্যে। বর্ষায় প্রকৃতি সাজে নবযৌবনের রূপে। পুষ্পে-বৃক্ষ, পত্রপলস্নবে পায় নতুন প্রাণের সুর। চারদিকে যেন নব উচ্ছ্বাসের জোয়ার জাগে। গ্রামের মাঠ-ঘাটগুলো বর্ষার ছোঁয়ায় জল থইথই করে। বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনিতে পেখম মেলে ময়ূর। খাল-বিলে ফুটেছে শাপলা, কলাপাতার রঙ আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। বর্ষা নিয়ে কাব্যের অভাব নেই বাংলা সাহিত্যে। ৩১ মে বা জুনের শুরুতেই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজবে পুরো দেশ।
চলতি মাসে ভারতে পুনে শহরে আবহাওয়া-বিষয়ক এক সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এবার বৃষ্টি রেকর্ড ভাঙতে পারে। গরমের জন্য দায়ী এল নিনোর পর মধ্য এপ্রিলে লা নিনা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে বর্ষায় বৃষ্টি যেমন বেশি হবে, তেমনি বাংলাদেশের উজানে ভারতের রাজ্যগুলোতেও বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বর্ষায় বাংলাদেশে বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। স্বাভাবিকের চেয়ে এবার ৪৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে আবহাওয়াবিদদের এমন ঘোষণায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন কৃষকরা। এ বছর জুনের শুরুতেই বর্ষা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণত মধ্য জুনের আগে বর্ষার মেঘমালা প্রবেশ করে বাংলাদেশ ও ভারতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে স্বাভাবিকের চায়েও গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম বলেন, সাধারণত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দু'টি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি বঙ্গোপসাগর অন্যটি ভারত সাগর অতিক্রম করে বৃষ্টি নামিয়ে বর্ষার শুরু করে। মৌসুমি বায়ুর একটি শাখা আরব সাগর দিয়ে কেরালা হয়ে ভারতে বৃষ্টি নিয়ে প্রবেশ করে বর্ষা। বঙ্গোপসাগরের শাখাটি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বৃষ্টি নামিয়ে কক্সবাজার
\হহয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বর্ষা। এরপর সারা দেশে ঝুম বৃষ্টি নামে। বর্তমানে যে হঠাৎ বৃষ্টি হচ্ছে, তা কালবৈশালীকে সঙ্গী করে।
জলবায়ুর প্রভাবে এখন ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। আবার কখনো চলে অতিবৃষ্টির বাড়াবাড়ি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়া তার ব্যাকরণ ভুলে শস্য পঞ্জিকায় অসময়ে হানা দিচ্ছে। প্রকৃতির বৈরী আচরণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি ও কৃষির উপখাত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুলাংশে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বর্ষার বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি বছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। ২০১৭ সালের শুরুতে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা আগাম ঢলে হাওড়ের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে যায়। ২০১৯ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের বৃষ্টি আগের ৫২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২০২০ সালের কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। ২০২০ সালের অসময়ের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ প্রতি বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারা দেশে ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি। এই তিন বছর প্রায় খরা অবস্থা চরম আকার ধারণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানুষ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। অসময়ে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।
আবহাওয়াবিদ ড. আসাদুজ্জান জানান, বৃষ্টি এক ধরনের তরল, যা আকাশ থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূপৃষ্ঠের দিকে পড়ে। প্রথিবীর বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘ যথেষ্ট পরিমাণে ভারি হলে তা বৃষ্টি আকারে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে- একেই বলে বৃষ্টি। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে বৃষ্টি সুপেয় জলের বড় উৎস। বিচিত্র জৈব ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে, জলবিদু্যৎ প্রকল্পগুলো সচল রাখতে ও কৃষি সেচব্যবস্থা সচল রাখতে বৃষ্টির প্রয়োজন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে।
উলেস্নখ্য, বৃষ্টিপাত মাপার ক্ষেত্রে বৃষ্টির ধারাকে মিলিলিটারে গণনা করা হয়। তারপর স্কেল অনুযায়ী পরিমাপ করে হালকা, ভারি, অতি ভারি ও চরম বৃষ্টিপাতের হিসাব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ঘন্টায় শূন্য দশমিক ২৫ মিলিমিটার থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে হালকা, ৪ মিলিমিটার থেকে ১৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে ভারি, ১৬ মিলিমিটার থেকে ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে অতি ভারি এবং ৫০ মিলিমিটারের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে চরম বৃষ্টিপাত আখ্যা দেওয়া হয়।