রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১

বছরজুড়ে ভোগাবে আলু-পেঁয়াজ

পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হিমাগার না থাকায় তাপপ্রবাহে বন্দরে নষ্ট হচ্ছে আলু বছরের শেষ দিকে ৪ গুণ পর্যন্ত বাড়বে দাম
রেজা মাহমুদ
  ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
বছরজুড়ে ভোগাবে আলু-পেঁয়াজ

দীর্ঘ দিন ধরেই দেশের বাজার অস্থিতিশীল। আমদানি নির্ভর পণ্যের পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ব্যয় মেটাতে মধ্যম আয়ের মানুষকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে আলু-পেঁয়াজের বাড়তি দামে নাজেহাল ভোক্তারা। এমনকি আমদানি করে সংকট সমাধান হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার বছরজুড়েই এই দুই পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে, বিশেষ করে বছরের শেষ দিকে ক্রেতা ব্যয় বাড়তে পারে তিন থেকে চার গুণ পর্যন্ত।

এদিকে চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই চড়া দেশের আলু-পেঁয়াজের বাজার। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা এখন তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যদিও দেশের আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে গত বছর প্রথমবারের মতো আলু আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এ ছাড়াও খুচরা পর্যায়ে আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণসহ জোরদার করা হয় বাজার মনিটরিং। কিন্তু বাজারে নির্ধারতি দাম কার্যকর করা যায়নি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের উচ্চ মূল্যে কারণে আমদানি করেও সংকট সমাধানের পথ সীমিত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। অন্যদিকে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির শুরু হলেও দেশটি পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে আমদানিকারকরা। এছাড়াও বর্তমানে দেশীয় আলু ও পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় আমদানিতে নিরুৎসাহী। অন্যদিকে গরমে বন্দরেই নষ্ট হচ্ছে আলু।

চলতি বছর কৃষকের আলু ও পেঁয়াজ আরও পাঁচ ও তিন মাস আগেই বাজারে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এ সময়ও দাম স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি ছিল। সম্প্রতি পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলেও বাজারে পর্যাপ্ত দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ রয়েছে। এই দুই পণ্যের যে পরিমাণ মজুদ রয়েছে তাতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত কোনো সংকট থাকার কথা না। কিন্তু এই মজুদ ফুড়িয়ে

গেলে অথবা শেষ পর্যায়ে বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি হবে। তখন বাজার পুরোপুরি নির্ভর করবে আমদানিকারক ও কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের ওপর।

পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি :চলতি সপ্তাহে বাজারে প্রতিকেজি দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৭৫ টাকার ওপরে, যা গত বছর এই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকার মধ্যে। তবে সে বছর অক্টোবরের দিকে এই দাম বেড়ে দেড়শ' ছাড়িয়ে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক আমদানি সত্ত্বেও এই দাম দফায় দফায় বেড়ে ৩শ' ছাড়িয়েছিল। তবে মৌসুমি মুড়ি কাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করলে ডিসেম্বরে দাম কমে ২শ' টাকা ও জানুয়ারিতে ১৩০ টাকা নামে। পরবর্তিতে মার্চের শুরুতে দেশীয় পেঁয়াজের প্রধান জাত হলি পেঁয়াজ বাজারে এলে দাম ১শ' টাকার নিচে নামে যায়। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।

এদিকে ভারত সরকার প্রতি টন পেঁয়াজে নূ্যনতম রফতানি মূল্য নির্ধারণ করেছে ৫৫০ মার্কিন ডলার। ডলারের বিনিময় মূল্য ১১৮ টাকা হিসাবে ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি মূল্য পড়ছে প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকা। এই দামের সঙ্গে যোগ হচ্ছে রফতানি শুল্ক, কাস্টমস শুল্ক, পরিবহণ ও শ্রমিক খরচ। এতে বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারকরা। ফলে দেশীয় পেঁয়াজের মজুদ সত্ত্বেও বাজারে এক ধরনের সরবরাহ সংকট তৈরি হচ্ছে।

এর আগে ভারতে পেঁয়াজের সংকট ও দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির সরকার। এরপর থেকে আমদানি বন্ধ ছিল গত ৪ মে পর্যন্ত। এর পর চলতি মাসে হিলির ২০ আমদানিকারক ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পান। কিন্তু ৪০ শতাংশ রফতানি শুল্ক নির্ধারণ করে দেওয়ায় অনুমতি পেলেও আমদানি করেননি আমদানিকারকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের এই দাম অব্যহত থাকলে এবং দেশীয় পেঁয়াজের মজুদ ফুড়িয়ে আসতে শুরু করলে বছরে শেষ ভাগে দাম তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে দেশে পেঁয়াজ এসেছে মাত্র সাত লাখ ১৮ হাজার টন। বাকি পেঁয়াজ এখনও আসেনি। এ পরিস্থিতিতে যদি ভারত রপ্তানি শুল্ক তুলে নেয় তাহলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য কমতে পারে।

আলুর বাজার পরিস্থিতি : চলতি সপ্তাহে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে, যা গত বছরের এই সময়ের বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। সে হিসাবে দাম বেড়েছে চার গুণ বেশি। যা আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, কৃষকের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিতে এবার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২১ টাকা বেশিতে দরে আলু কিনতে হয়েছে তাদের। এ ছাড়াও মৌসুমের শুরুতে আলুর বাড়তি দাম থাকায় কৃষক অপরিপক্ক আলু তুলে বিক্রি করেছেন, এতে আলুর উৎপাদনও কমেছে। ফলে স্বাভাবিক সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাবে মজুদকৃত আলু। তখন আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি মৌসুমে প্রতি হেক্টরে আলু উৎপাদন হয়েছে ২৮ দশমিক ৬০ টন; যা গত বছর হয়েছিল ৩০ দশমিক ১০ টন। অর্থাৎ হেক্টরপ্রতি আলুর উৎপাদন ১ দশমিক ৫০ টন কমেছে। মূলত আলু বড় হওয়ার আগেই তুলে ফেলায় কমেছে মোট উৎপাদন।

এদিকে উৎপাদন সংকটে কমছে আলু রপ্তানি। গত বছর ১২ হাজার টন রপ্তানি হলেও এ বছর তা ১৫০ টনে নেমেছে। তবু গত বছরের শেষ দিকে দেশের চাহিদা পূরণে প্রথমবারের মতো আলু আমদানি করতে বাধ্য হয় সরকারকে। এ অবস্থায় চলতি বছর অক্টোবরেরই আলুর বাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

এদিকে চলতি বছর আলু আমদানি আলু আমদানির পরিমাণ বাড়লেও কমছে না দাম। উল্টো আমদানিকারকদের দাবি, ভারতের বাজারেই আলুর দাম বেশি। ফলে বেশি দামে আমদানি করে সে অনুযায়ী দেশের বাজারে সরবরাহ করতে হচ্ছে।

হিলি স্থলবন্দরের তথ্যনুযায়ী দেশের বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানির অনুমতি পাওয়ার পর থেকেই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আলু আসা অব্যাহত রয়েছে। তবে ভারতের অতিবৃষ্টির ফলে অনেক এলাকায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় ভারতের বাজারেই আলুর দাম পাঁচ-সাত রুপি বেড়েছে। ফলে রফতানিকারকরা বাড়তি দামে আলু রফতানি করছে তারা।

অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় বন্দর দিয়ে আলু আমদানি বেড়েছে। আগে ৫-১০ ট্রাক আলু আমদানি হলেও ঈদের পর তা বেড়ে ২৫-৩০ ট্রকে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু দেশের ্‌বাজারে সরবরাহ সংকটের দোহাই দিয়ে বেড়েই চলছে অতিপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের দাম।

এদিকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আনা ভারতীয় আলু তীব্র গরমে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের আর্থিক ক্ষতিপরিমাণ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাজারে। হিলিবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সেখানে হিমাগার ব্যবস্থা না থাকায় চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে আলু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রম্নপের সভাপতি হারুন উর রশিদ জানান, দেশে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার আলু আমদানি করার অনুমতি দেয়। ফলে বন্দরের আমদানিকারকরা প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আলু আমদানি করছেন। কিন্তু আমদানি করার পর ভারতীয় ট্রাক থেকে আলুর বস্তাগুলো খালাস করে গুদামে ২/৩ দিন মজুদ থাকে। তীব্র গরমে অনেক আলুই পচে নষ্ট হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আগামীতে আলু আমদানি কমে যাবে। ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের বর্তমান মূল্য ও দেশীয় আলুর উৎপাদন হ্রাসে এমনিতে বাজারে আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে যতি আমদানিকৃত আলু সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয় তাহলে বাজার নাগালের বাইরে চলে যাবে।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে