হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত

ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি নিহত

পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সবার মরদেহ উদ্ধার বিশ্বনেতাদের শোক ও সমবেদনা ইরানে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক মোখবার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন

প্রকাশ | ২১ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ইব্রাহিম রাইসি :১৯৬০-২০২৪
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোলস্নাহিয়ানসহ হেলিকপ্টারে থাকা সবাই নিহত হয়েছেন বলে ইরানের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃতু্যর খবর নিশ্চিত করেছে। সোমবার সকালে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি ও তুষারাবৃত এলাকায় ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অনুসন্ধানী দল। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়, সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। এর আগে, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার এলাকায় একটি 'হিট সোর্স' (উত্তপ্ত স্থান) শনাক্ত করেছিল তুরস্কের পাঠানো ড্রোন। হেলিকপ্টারটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানে পৌঁছে কার্যক্রম শুরু করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃতু্যর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর অন্তর্র্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ মোখবারের নাম অনুমোদন করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুলস্নাহ খামেনি। তিনি দুই মাস এ দায়িত্ব পালন করবেন। ইরানের কোনো প্রেসিডেন্ট অসুস্থতা, মৃতু্য, অভিশংসন বা সংসদ কর্তৃক অপসারণের ফলে দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হলে করণীয় কী, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির সংবিধানে। এতে বলা হয়েছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে মোহাম্মদ মোখবার) রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। একই সঙ্গে সংসদ এবং বিচার বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে যৌথভাবে পরবর্তী সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করবেন তিনি। এসব কিছুই হতে হবে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন সাপেক্ষে। কারণ ইরানের যেকোনো বিষয়ে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। রোববার আজারবাইজানের সীমান্তের কাছে দু'টি বাঁধ উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এরপর হেলিকপ্টারে ইরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদোলস্নাহিয়ান ছাড়াও আরও ছিলেন ধর্মীয় নেতার (খামেনি) প্রতিনিধি ও তাবরিজের ইমাম সৈয়েদ মোহাম্মদ আল হাশেম, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালিক রাহমাতি, প্রেসিডেন্ট প্রোটেকশন ইউনিটের কমান্ডার সরদার সৈয়েদ মেহদি মৌসভি, কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী এবং ক্রুরা। তাবরিজ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হেলিকপ্টারটি। কিন্তু ভারী কুয়াশা থাকায় অনুসন্ধান অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্টের বহরে মোট তিনটি হেলিকপ্টার ছিল। অন্য দু'টি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করে। পূর্ব আজারবাইজানের ডেপুটি গভর্নর ফর ডেভেলপমেন্ট আলি জাকারি স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান 'ওই বহরে তিনটি হেলিকপ্টার ছিল এবং অন্য দু'টি নিরাপদে অবতরণ করতে পেরেছে। একটি বিধ্বস্ত হয়েছে।' নিরাপদে ফেরা হেলিকপ্টারে জ্বালানি মন্ত্রী আলী আকবর মেহরাবিয়ান এবং আবাসন ও পরিবহণমন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাশ ছিলেন। ইরানের আধা সরকারি তাসনিম নিউজ এজেন্সি বলছে, হেলিকপ্টারের ভেতরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকা লোকজন জরুরি কল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্থানীয় গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন, হেলিকপ্টারের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগ করা হয়েছিল, তবে তিনি এর বাইরে আর কোনো ব্যাখ্যা দেননি। দুর্ঘটনার বিষয়ে সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার জানিয়েছেন, মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। 'এখন পর্যন্ত সন্দেহ করার মতো কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু, তিনি পরিস্থিতির দিকে নজর রাখবেন।' এর আগেও আকাশপথে দুর্ঘটনায় দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। প্রতিরক্ষা ও বিভিন্ন সময়ে পরিবহণমন্ত্রী, ইরানের রেভলু্যশনারি গার্ড ও সেনাবাহিনীর কমান্ডার বিমান বা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। ইব্রাহিম রাইসি একদিন আগে প্রতিবেশী আজারবাইজানে ছিলেন। তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। ৬৩ বছর বয়সি রাইসি ২০২১ সালে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশটির মরালিটি বা নৈতিকতা-বিষয়ক আইন কঠোর করার নির্দেশ দেন। তাকে একজন কট্টরপন্থি ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে তিনি সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখেও পড়েছেন। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় তিনি কঠোর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকে মনে করেন তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুলস্নাহ আলী খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা তাকে বিচার বিভাগের প্রধানের শক্তিশালী পদে নিযুক্ত করেন। রাইসি বিশেষজ্ঞদের অ্যাসেম্বলির ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হন। ইরানে ৮৮-সদস্যের এই বোর্ড দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে। ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এদিকে দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ তার সফরসঙ্গীরা নিহত হওয়ার পর পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনি। একইসঙ্গে ইরানের অন্তর্র্বর্তী প্রেসিডেন্ট পদে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারের নিয়োগ নিশ্চিত করেছেন তিনি। ইরানের সরকারি ইরনা বার্তা সংস্থায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে খামেনি বলেছেন, 'আমি ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করছি। ইরানের জনগণের প্রতিও আমার সমবেদনা জানাচ্ছি।' 'মোখবার নির্বাহী শাখা পরিচালনা করবেন এবং আইনসভা ও বিচার বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে মিলে সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।' রাইসির জানাজা আজ ইরানের সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির জানাজা আজ তাবরিজে অনুষ্ঠিত হবে। সংবাদমাধ্যম তাসনিম দেশটির ইসলামিক রেভলু্যশানি গার্ডস্‌ কর্পসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে তাসনিম আরও জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তার নিহত সফরসঙ্গীদের জানাজা হবে সেখানে। তার আগে, মরদেহগুলো তাবরিজের ফরেনসিক বিভাগে রাখা হবে।