ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের তান্ডবে রণক্ষেত্র মিরপুর

ট্রাফিক পুলিশের দুটি বক্স জ্বালিয়ে দিয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে বাসসহ অন্তত ১০টি গাড়ি হ যানজটে নাকাল নগরবাসী

প্রকাশ | ২০ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে রোববার মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন অটোরিকশা চালকরা। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় -নাজমুল ইসলাম
ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ও মালিকদের তান্ডবে ঢাকার মিরপুর সকাল থেকে দিনভর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিক্ষোভকারীরা কালশীর দুটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর শেষে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। তারা মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় তিনটি বাসসহ অন্তত ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়ে সাগর নামে এক পথচারী আহত হয়েছেন। দফায় দফায় সংঘর্ষে দশ পুলিশ ও পথচারীসহ অন্তত ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষের জেরে প্রায় ৭ ঘণ্টা পুরো মিরপুর এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। যার প্রভাবে গোটা নগরীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকাল ৫টার দিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ও মালিকরা ঢাকার পলস্নবী থানাধীন কালশী নতুন রাস্তার মোড়ে থাকা দুটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশের ধাওয়ার মুখে বিক্ষোভকারীরা কালশী চার রাস্তার মোড়ে ও কবরস্থানের কাছে অবস্থিত বিভিন্ন গলিতে ও বাজারে ঢুকে পড়েন। পরে সেখান থেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। স্থানীয়রা জানান, এ সময় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের হটাতে লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেন। পথচারী ছাড়া পুলিশও আহত হন সংঘর্ষে। রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়ে সাগর নামে এক পথচারী আহত হন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। সংঘর্ষে দশ পুলিশ ও পথচারী এবং বিক্ষোভকারীসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করলে তারা ইসিবি চত্বরের রাস্তার দিকে গিয়ে অবস্থান নেন। প্রায় ৬ ঘণ্টা রাস্তাটি অবরোধ করে রাখেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাস্তাটি দিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দিন মোলস্না যায়যায়দিনকে বলেন, ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশাচালক ও মালিকরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তারা পুলিশের ওপর হামলা করেন। হামলায় আমিসহ বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। দুপুর ১২টার দিকে প্রথম দফায় বিক্ষোভকারীদের মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে আবারও তারা এখানে আসেন। সবশেষ দুপুর ২টার দিকে তাদের মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তারা কালশী নতুন চার রাস্তার মোড়ে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের দুটি বক্স ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ জানায়, উচ্চ আদালত ঢাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এছাড়া চলতি বছরের ১৫ মে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও ঢাকায় ব্যাটারিচালিক রিকশা চলাচল না করতে দেওয়ার পক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেন সংশ্লিষ্টদের। পুলিশ বলছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক শনিবার রাত থেকেই ঢাকার মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করতে অভিযান শুরু করা হয়। একই সঙ্গে রোববার সকাল থেকেই মিরপুরের সব রাস্তায় বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোলস্না যায়যায়দিনকে আরও জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। মিরপুর-১১, মিরপুর-১, আগারগাঁও এবং কালশী এলাকার শত শত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিকালে তারা কালশীতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের দুটি বক্স ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। আবারও তারা ঝামেলা তৈরির চেষ্টা করলে পরে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা নাগাদ মিরপুর এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে মিরপুর এলাকার প্রতিটি রাস্তায় সব ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে যানবাহনগুলোর চালক ও মালিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা মিরপুর-১, মিরপুর-১১, পলস্নবী, শাহ আলী, দারুস সালাম থানা এলাকাসহ বিভিন্ন পাড়া-মহলস্নায় একত্রিত হতে থাকেন। প্রথমে কালশী এলাকা থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন শত শত ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ও মালিক। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক ও চালকরা। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের পস্ন্যাকার্ড দেখা যায়। একপর্যায়ে শত শত ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকরা বিক্ষোভ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকেন মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে। তাদের হাতে নানা লেখা সংবিলত পস্ন্যাকার্ড চোখে পড়ে। কোনো কোনো পস্ন্যাকার্ডে সরকারকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছিল, 'হয় রিকশা চালাতে দিবেন, অন্যথায় বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিবেন'। আবার কোনো কোনো পস্ন্যাকার্ডে লেখা ছিল, 'হয় রিকশা চলতে দেন, নতুবা বিকল্প কর্ম দেন'। সকাল ১০টার দিকে মিরপুর গোলচত্বরের চারদিকের ৮টি রাস্তায় অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। এতে করে বন্ধ হয়ে যায় ওইসব রাস্তায় চলাচল করা সব যানবাহন। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। এ সময় পুলিশ দ্রম্নত বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে রাস্তা খালি করার চেষ্টা করে। বিক্ষোভকারীরা তাদের দাবি মেনে নিতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। পুলিশের ভাষ্য, ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালত ও সরকারের। তাদের কিছুই করার নেই। তারা আদালত ও সরকারের হুকুম পালন করছেন। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বাগ্‌বিতন্ডা থেকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ বেশ কিছু বিক্ষোভকারীকে আটক করে। এতে করে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সেখানে হাজির হয়। টানা প্রায় দুই ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা। একপর্যায়ে পুলিশ আটককৃতদের অনেককেই ছেড়ে দেয়। পুলিশের ধাওয়ার মুখে রাস্তা থেকে বিক্ষোভকারীদের বড় একটি অংশ চলে যান। রাস্তায় যানবাহন চলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক হয়। তখন দুপুর ১২টা। দেখা গেছে, দুপুর ১২টার খানিকটা পরই আবারও বিক্ষোভকারীরা মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরসহ আশপাশের রাস্তায় অবস্থান নেন। তারা পুরোপুরি রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেন, ব্যাটারিচালিক রিকশা চলা বা না চলা পুলিশের বিষয় না। এটি সরকারের বিষয়। সরকার যেহেতু নিষিদ্ধ করেছে তাই তারা সেই দায়িত্ব পালন করছে। দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে পুলিশ শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। একপর্যায়ে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয় এমপি ও জনপ্রতিনিধিরাও বিক্ষোভকারীদের রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। তাতেও কোনো কাজ না হলে পুলিশ একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। তখন দুপুর ২টা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় চার ঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হলে আচমকা বিক্ষোভকারীরা পর পর কয়েকটি যাত্রীবাহী বাসসহ বেশ কিছু যানবাহনে ভাঙচুর করে। এ সময় অনেক বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল দেখা গেছে। তারা যানবাহন ভাঙচুরে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল ব্যবহার করেন। এমন পরিস্থিতিতে পথচারীসহ যানবাহনের যাত্রীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ আতঙ্ক আর ভয়ে নিরাপদ জায়গার দিকে ছুটতে থাকেন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ মিরপুর-১০ নম্বর এলাকাসহ আশপাশের রাস্তায় অবস্থান নেন। একপর্যায়ে পুলিশের তৎপরতার মুখে বিক্ষোভকারীরা বিকাল ৫টার দিকে এলাকা ত্যাগ করেন। এ ব্যাপারে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সির সাব্বির আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে শনিবার দিবাগত রাত থেকেই অভিযান চলছে। ইতোমধ্যেই অন্তত অর্ধশত অবৈধ ব্যাটারিচালিত যানবাহন জব্দ করা হয়েছে। আরও জব্দ করার প্রক্রিয়া চলমান আছে। বিক্ষোভকারীরা তিনটি বাসসহ অন্তত ৮ থেকে ১০টি যানবাহন ভাঙচুর করেছেন। যানবাহন ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে প্রাথমিকভাবে একজনকে আটক করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। তবে রাত ৮টা নাগাদ কোনো মামলা হয়নি। তিনি আরও জানান, বিক্ষোভকারীদের কারণে পুরো এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। বিকাল ৪টার দিকে বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এরপর যানবাহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে পুলিশের টহল ব্যবস্থাও। একই সঙ্গে মিরপুর থানাধীন যেসব এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ আছে, ওইসব এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে মিরপুর থানা এলাকায় ঠিক কী পরিমাণ এ ধরনের যানবাহন চলাচল করে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে। মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে থাকা পুলিশ বক্সে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীরা। তবে বিক্ষোভকারীদের হটাতে কোনো ধরনের রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়নি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিকালে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ মিরপুরের কালশী এলাকার তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থান নিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে তারা দুটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এমন ঘটনায় ওই এলাকার রাস্তাগুলোতে যানজটে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। বিশেষ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মহাখালী ও কুড়িলসহ ওইসব এলাকাগামী সব যানবাহন আটকা পড়ে। যানবাহনগুলোর যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়। মিরপুরে বিক্ষোভের প্রভাব পড়ে প্রায় পুরো ঢাকায়। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় ওই বিক্ষোভের প্রভাবে যানজটের সৃষ্টি হয়। যা নগরবাসীকে এক প্রকার নাকাল করে ফেলেছিল।