চট্টগ্রামের বাবর আলী পাহাড় জয় করতে দেড় মাস আগে যখন দেশ ছেড়েছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা তার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপূরণে এই তরুণ বেশি সময় নেননি। রোববার সকালে এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন বাবর।
কৈশোরে বাবর ছিলেন সামান্য ডানপিটে। পড়ালেখায় ছিলেন অন্যসব ছেলেদের মতোই, বোধকরি আরেকটু বেশি। নয়তো চট্টগ্রামে মেডিকেলে পড়া সম্ভব হতো না। এনাটমি নিয়ে পড়তে-পড়তেই কীভাবে যেন বাইরের দুনিয়া দেখার শখ জাগে। তবুও কতো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব পেরিয়েও ডাক্তারি থেকে রেহাই নেই।
কিন্তু, যার চোখ আটকে যায় পাহাড়ের খাঁজে সে কি স্থির থাকতে পারে? বাইরে তাকে বেরুতেই হবে। অতএব জাতিসংঘের ওপর ভর করে রোহিঙ্গা শিবিরে। ততদিনে দেশ-বিদেশের বহু সৌন্দর্যে সে বিমোহিত। রোমাঞ্চের নেশায় হেঁটে বেড়ালেন দেশের চৌষট্টটি জেলা। ঠিক যেন জমছিল না। পরবর্তীতে ভারতের নেহেরু ইনস্টিটিউট থেকে রোমাঞ্চনীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু করেন পাহাড় চড়ার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। বলাবাহুল্য তার আগে কতো কি ছেড়ে এসে ধরিত্রীর ধুলো গায়ে মেখেছেন বাবর।
এদিকে, তার মনের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অথচ সবচেয়ে উজ্জীবিত একটা ইচ্ছেকে পোষণ করেই অনুবাদ করে ফেললেন পর্বতারোহণের ইতিহাসের প্রথম 'ইনভিঞ্চিবল' কিংবদন্তি জর্জ ম্যালরির এভারেস্ট অভিযান। সেই গল্পের অনুবাদ করতে-করতেই কিংবা আরও আগেই এভারেস্ট নামের এক উজ্জীবিত উচ্ছ্বাস তাকে পেয়ে বসেছে কিনা কে জানে।
তবে, বাবর আলী নামের সেই ভীষণ ডানপিটে কিশোর জীবনের অনেক পথ হেঁটেছেন। অনেক পাহাড় পেরিয়েছেন। কে জানে একটা ভীষণ স্বপ্নের আনন্দেই হয়তো সাওয়ার হন সাইকেলে। পাড়ি দেন মহাভারতের দেশ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী।
অতঃপর, স্বপ্নটাকে ছোঁয়ার পালা। কিন্তু, যে দেশের মানুষ সংখ্যায় এত বেশি হওয়ার পরও লাখে একজনও পর্বতারোহণে নেই,
সে দেশে অর্ধকোটি টাকা বিনোয়োগ কে করবে। নিজের পকেটতো বহু আগেই ফাঁকা করে ফেলেছে তীব্র সৌন্দর্যের পৃথিবী।
অতসব ভাবলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি থামলেও থেমে যেতে পারে, তবে সেই স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে না। অতএব, বাবর আলীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিলেন। যে স্বপ্নের সারথি ছিল তার স্বপ্নে বিভোর হওয়া আরো শতসহস্র মানুষ।
গত ১ এপ্রিল হিমালয়ের শীতিধার চূড়া জয়ের জন্য রওনা দিয়েছিলেন বাবর আলী। রোববার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে (নেপাল সময় ৮:৩০ মিনিট) পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় সেই সতেরো কোটি মানুষের লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন। চূড়াটি পর্বতের ১৫ হাজার ৫০০ ফুট উপরে। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ১১ বছর প্রতীক্ষার পর তৃতীয় মেরুতে উড়ল লাল-সবুজের পতাকা। স্বাক্ষ্য দিয়েছেন অসম্ভবকে সম্ভব করার এক দুর্জয় ও রোমাঞ্চের জীবন। বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান। পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী বাংলাদেশিদের মধ্যে পঞ্চম এবং চট্টগ্রামের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করলেন।
প্রসঙ্গত, ডা. মো. বাবর আলীর বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর গ্রামে। এই তরুণ চিকিৎসক নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। করোনায় সময় তার ভূমিকা বেশ প্রশংসনীয় ছিল। ৩৩ বছর বয়সি বাবর আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তিনি ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। এরপর শুরু করেন চিকিৎসা পেশা। তবে থিতু হননি। চাকরি ছেড়ে দেশ-বিদেশ ঘোরার কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। সাইকেলিংয়ের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত সারগো রি (৪ হাজার ৯৮৪ মিটার), সুরিয়া পিক (৫ হাজার ১৪৫ মি.), মাউন্ট ইয়ানাম (৬ হাজার ১১৬ মি.), মাউন্ট ফাবরাং (৬ হাজার ১৭২ মি.), মাউন্ট চাউ চাউ কাং নিলডা (৬ হাজার ৩০৩ মি.), মাউন্ট শিবা (৬ হাজার ১৪২ মি.), মাউন্ট রামজাক (৬ হাজার ৩১৮ মি.), মাউন্ট আমা দাবলাম (৬ হাজার ৮১২ মি.) ও চুলু ইস্ট (৬ হাজার ০৫৯ মি.) পর্বতের চূড়ায় উঠেছেন এই তরুণ।
যদিও বাবরের অভিযান এখনো শেষ হয়নি, তার লক্ষ্য শুধু এভারেস্ট নয়, সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসেও। ক্যাম্প-৪ এ নেমে মাঝরাতে আবারও দ্বিতীয় লক্ষ্যের পথে যাত্রা শুরু করে আজ পৌঁছার কথা এর চূড়ায়।