রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১

কূল খুঁজে পাচ্ছে না 'ডুবন্ত' আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক

দীর্ঘদিন থেকে সমস্যাগ্রস্ত এই ব্যাংকটিতে ছিল তারল্য সংকট। আমানত সংগ্রহ করে কোনোমতে চলছিল। সর্বশেষ ব্যাংক একীভূতকরণ আতঙ্কে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলনের কারণে তারল্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে
এম সাইফুল
  ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
কূল খুঁজে পাচ্ছে না 'ডুবন্ত' আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক

শুরু আল-বারাকা ব্যাংক নামে, মাঝখানে কিছুদিন ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বারবার নাম বদলাদেও উন্নতি হয়নি ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার। কূল-কিনারা না পেয়ে ডুবতে বসেছে ব্যাংকটি। প্রতি বছরই বাড়ছে লোকসান। নগদ টাকার সংকটে চেক নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন গ্রাহকরা। এ যেন অনেকটা অধুনালুপ্ত ফারমার্স ব্যাংকের পুনরাবৃত্তি।

অথচ ব্যাংকটির ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ মালিকানা বিদেশিদের হাতে। তারাই ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। সরকারের শেয়ারও রয়েছে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিও। তবুও কাটছে না সংকট। তাই ব্যাংক একীভূতকরণ তালিকায় আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নাম।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে সমস্যাগ্রস্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ছিল তারল্য সংকট। আমানত সংগ্রহ করে কোনোমতে চলছিল। সর্বশেষ ব্যাংক একীভূতকরণ আতঙ্কে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলনের কারণে তারল্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে। সেই অনুযায়ী পাচ্ছে না নতুন আমানত।

অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে থাকা ব্যাংকটি এখন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ১০ হাজার টাকার বেশি চেক দিলে ব্যাংকটির গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না। কর্মচারীদের বেতনও পরিশোধ করতে হচ্ছে ধাপে ধাপে।

নগদ টাকার সংকটে নতুন ঋণ বিতরণও বন্ধ। টানা লোকসান, মূলধন ঘাটতি ও উচ্চ খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকটি। স্বল্পমেয়াদে তারল্য মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ ধারও করতে পারছে না। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশও দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, তাদের এমন কোনো সিকিউরিটিজ নেই, যার বিপরীতে অন্য ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারবে।

গেল সপ্তাহে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের

মৌলভীবাজার শাখা থেকে গ্রাহকের টাকা দিতে পারেনি বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ শাখাতেই একই অবস্থা। নানা অব্যবস্থাপনায় বিতরণ করা ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না। খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংক।

ব্যাংকে নগদ টাকা সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন গ্রাহকরা। প্রতিদিন গ্রাহকরা টাকা তুলতে এসে হতাশ হয়ে ফিরছেন খালি হাতে। ফলে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এ ব্যাপারে তারা অসহায়। ব্যাংকে নগদ টাকা না থাকায় চাহিদানুযায়ী সেবা দিতে পারছেন না। গ্রাহকদের ধৈর্র্য ধরার কথা বলছেন তারা। সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকার বেশি উত্তোলন করতে পারছেন না গ্রাহকরা। কাউকে ৫ হাজার কারও হাতে ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। ফলে যেসব গ্রাহকরা ব্যবসায়িক বা অন্যান্য কাজের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা তুলতে আসছেন তাদের হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। এই নিয়ে বাকবিতন্ডাও হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্রাহকদের।

বর্তমানে ব্যাংকটির ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ মালিকানা আইসিবি ফিনান্সিয়াল গ্রম্নপের হাতে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে আছে ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ মালিকানা, সরকারের শেয়ারও রয়েছে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ আর সাধারণ জনগণের হাতে ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।

সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে লোকসান করেছে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রতিবছর লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি।

সর্বশেষ ৩১ মার্চ ২০২৪ সমাপ্ত প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন মতে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২১ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে লোকসান ছিল ১৯ পয়সা।

৩১ মার্চ, ২০২৪ সমাপ্ত প্রথম প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে মাইনাস ১৯ টাকা ৫৭ পয়সা। বাজারে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩ টাকা ৮০ পয়সায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটির ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ৭৯০ কোটি ৪ লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের ৮৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

আর্থিক সংকট নিরসনে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতহীন ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তার আবেদন করেছিল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। তবে দুই সপ্তাহ পর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দায় ছিল।

এদিকে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। ফ্রোজেন ডিপোজিট হলো ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানত, যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে রেখেছিল। ব্যাংকটির ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ২ হাজার কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

১৯৮৭ সালে আল-বারাকা ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু। ১৯৯৪ সালে এটি 'ত্রম্নটিযুক্ত ব্যাংকে' পরিণত হয়। তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ত্রম্নটিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রথা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০০৪ সালে এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে।

তবে সেখানেও মালিক পক্ষের ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ার পর ২০০৬ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয়।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ৩৪টি মামলা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকের প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস আইসিবি ব্যাংকিং গ্রম্নপের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেন দু'জন দরদাতা। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।

ব্যাংকটির সমস্যার কথা স্বীকার করেন বোর্ড সচিব রবিউল আলম উজ্জ্বল। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিগত কিছু দিন ধরে ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ নিয়ে নানা আলোচনায় গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাই টাকা উত্তোলনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই ধাক্কা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমরা কোনো তারল্য সুবিধা পাই না। তাই নতুন আমানত নিয়েই সমাধান করতে হবে।' এই মাসের মধ্যে তারল্য সমস্যা কেটে যাবে বলেও জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে