শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

কালো টাকা পাচারের ঘুঁটি হয়ে উঠেছে বার সিঙ্গাররা

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০
প্রতীকী ছবি

নানা ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ আগে ক্যাসিনোর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হলেও ২০১৯ সালের শেষভাগের্ যাব-পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এসব জুয়াড়িদের অনেকে এখন নতুন করে অনলাইন জুয়ার দিকে ঝুঁকেছে। সেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে।

এছাড়া দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালরা প্রতিরাতে নামিদামি হোটেল ও বারের অবৈধ গানের জলসায় দু'হাতে কালো টাকা উড়াচ্ছে। যা ঘুরে-ফিরে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খায়েস মেটাতে দুর্নীতিবাজ চক্র হয়ে উঠছে আরও বেপরোয়া।

উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের পাচার রোধে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তৎপরতা বাড়াচ্ছে। অনলাইন জুয়া বন্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সম্প্রতি বেটিং সাইট ও অ্যাপগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। দেশের কোন জেলায় কোন অ্যাপ বা সাইট ব্যবহৃত হচ্ছে তা জানতে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এদিকে হোটেল-বারের অবৈধ জলসায় কোটি কোটি টাকা উড়ানো দুর্নীতিবাজদের অবৈধ আয়ের উৎস খুঁজতে গোয়েন্দারা মাঠে নামছেন। একই সঙ্গে মধুচক্রের আসর জমানো হোতাদের টাকা কোন পথে কীভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে তার ৫

রুট খোঁজা হচ্ছে। দায়িত্বশীল একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০০ হোটেল ও বারে প্রতিরাতে গানের জলসা বসছে। এর মধ্যে হাতেগোনা মাত্র চার থেকে পাঁচটি হোটেলে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার অনুমতি রয়েছে। বাকি হোটেলগুলো স্থানীয় থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে এ অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব জলসার সামনের সারিতে বসে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা বার সিঙ্গারদের গানের তালে তালে মধ্যরাত পর্যন্ত মদপান করছে। এ সময় তারা পাঁচশ' ও হাজার টাকার নোটের বান্ডিল খুলে শিল্পীদের গায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। তবে প্রতিরাতে প্রতিটি জলসায় প্রকাশ্যে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা উড়ানো হলেও গোপন লেনদেনের পরিমাণ কোটি টাকার কম নয় বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা মদ ও গানের জলসায় শুধু যে টাকা উড়িয়ে ফূর্তি করেন তাই না, সেখানকার বার সিঙ্গারদের তাদের কালো টাকা পাচারের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন। তারা হোটেলের পানশালার নারী শিল্পীদের সফরসঙ্গী বানিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান। এ সময় নানা কৌশলে অর্থ পাচার করেন। বিনিময়ে বার সিঙ্গারদের মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়।

সম্প্রতি তৃপ্তি বিশ্বাস নামের এক নারী বার সিঙ্গারের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। জানা যায়, হিন্দু ধর্মালম্বী এই বার সিঙ্গারের তৃপ্তি বিশ্বাস নামে বর্তমান পাসপোর্ট থাকলেও মুসলিম নামে আরও একটি পাসপোর্ট রয়েছে। মুসলিম নামের পাসপোর্টে বেশ কয়েকবার প্রতিবেশী দেশ ভারত সফর করেছেন। তার সঙ্গে মানব নামের একজন ভারতীয় নাগরিকের যোগসূত্র রয়েছে। যার সঙ্গে বিভিন্ন হোটেলে তৃপ্তির সঙ্গে মানবকে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কালো টাকার মালিকদের অর্থ বিদেশে পাচারের জন্য তৃপ্তি বিশ্বাস মানবকে ব্যবহার করছেন। তৃপ্তি বিশ্বাস অর্থ পাচারের কাজে তার মা-বাবাকে সম্পৃক্ত করার জন্য অতিসম্প্রতি মানবের মাধ্যমে তাদের ভারতীয় ভিসার ব্যবস্থা করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী হাফিজ, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শ্যামলের সঙ্গে তৃপ্তি বিশ্বাসের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তাদের লা-ভিঞ্চি, হলিডে ইন, পূর্বাণী, সেরিনা এসব হোটেলের বারে একাধিকবার একসঙ্গে দেখা গেছে। এসব তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, আরও একাধিক কালো টাকার মালিক তৃপ্তি বিশ্বাসকে ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। যদিও ওই নারীর নিকটাত্মীয়-স্বজনরা এ অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন। তবে অবৈধ অপতৎপরতার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সামান্য একজন বার সিঙ্গার কীভাবে দামি গাড়ি হাঁকান এবং বেকার স্বামী নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন তা জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তৃপ্তি বিশ্বাস নিজের নামে গাড়ি কেনার জন্য যে আয়কর সার্টিফিকেট ব্যবহার করেছেন তা-ও ভুয়া বলে অভিযোগ উঠেছে, যা আর্থিক গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন। গত ৫ মে উপকর কমিশনার কার্যালয় থেকে তৃপ্তি বিশ্বাসকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তিনি ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া আয়কর আইন, ২০২৩ এর ২৭২ অথবা ২১২ ধারা অনুসারে ২০২৩-২৪ কর বছরের জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেননি বলে উলেস্নখ করা হয়েছে।

নানা ধরনের অবৈধ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অতি সম্প্রতি এই বার সিঙ্গারকে বিজয়নগরের হোটেল ঈশা খা এবং কাকরাইলের হোটেল ৭১ এর শিল্পী তালিকা থেকে বস্ন্যাক করা হয়েছে। তাদের বাইরে বস্ন্যাক করা হয়েছে বার সিঙ্গার শ্যামলী আক্তার রুনু ও এইচ এ রূপাকে। এছাড়াও বার সিঙ্গারদের কারও কারও বিরুদ্ধে কালো টাকার মালিক ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের বস্ন্যাকমেইলিংয়েরও বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বার সিঙ্গার তৃপ্তি বিশ্বাস চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ীকে বস্ন্যাকমেইলিং করতে মধ্যরাতে ওই ব্যবসায়ীর ঢাকার স্বামীবাগের বাসায় যান। যে বাসায় ওই ব্যবসায়ী একাই বসবাস করেন। যার সিসি ফুটেজ পাওয়া গেছে।

আবাসিক হোটেলে মদ ও নাচ গানের আসর বসানো প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল ছাড়া অন্য কোনো হোটেল বা বারে মদের আসর বসিয়ে সেখানে নারীদের দিয়ে নাচ গান করানোর আইনগত সুযোগ নেই। যেসব বার ও হোটেলে অবৈধভাবে এসব কার্যক্রম চলছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

শিগগিরই এ ব্যাপারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে। ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল কর্তৃপক্ষ দেশি-বিদেশি মদ বিক্রির পাশাপাশি নাচ গানের আসর বসানোর অনুমতি পেয়ে থাকে। কোনো তিন তারকা হোটেলেও এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। যেসব হোটেল ও বারে এসব অবৈধ কর্মকান্ড চলছে, ওইসব প্রতিষ্ঠান গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হচ্ছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বার সিঙ্গারদের দিয়ে কালো টাকার মালিকদের অর্থ পাচার, এনজয় টু্যরসহ অন্যান্য অনৈতিক কর্মকান্ডের যোগসূত্র তৈরি করে দিচ্ছে হোটেলে বারের পার্টি অ্যারেঞ্জার গ্রম্নপ। এ জন্য তারাও মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে থাকেন। এরই মধ্যে এ চক্রের কয়েকজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে