অতীত ভুলে সামনে তাকাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু -সংগৃহীত
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় দুই দেশের মধ্যে যে 'উত্তেজনা' তৈরি হয়েছিল, তা ভুলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সামনে তাকাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ সফরে এসে গত দুই দিনে আমি দুই দেশের জনগণের মধ্যে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন (বাংলাদেশে) অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক।' ডোনাল্ড লু বলেন, 'আমরা এখন সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্ক জোরদারের উপায় খুঁজে বের করতে চাই।' দুই দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা পুনর্র্নির্মাণের চেষ্টা করাই তার এবারের বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য বলে মন্তব্য করে ডনাল্ড লু বলেন, 'সবাই জানেন, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেক উত্তেজনা ছিল। এখানে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতাহীন নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কঠোর পরিশ্রম করে। এর ফলে কিছু উত্তেজনা তৈরি হয়।' এই উত্তেজনাকে সম্পর্কের (কূটনীতি) সাধারণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার উপায় খুঁজতে চাই। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যেসব কঠিন বিষয় রয়েছে, সেগুলো নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে মন্ত্রীর (হাছান মাহমুদ) সঙ্গে কথা বলেছি।' কঠিন বিষয় বলতে র্'যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শ্রম সংস্কার, মানবাধিকার ও ব্যবসায় পরিবেশের সংস্কার' এর কথা বলেছেন এই মার্কিন সহকারী মন্ত্রী। এসব কঠিন ইসু্যতে কাজ করার জন্য ইতিবাচক সহযোগিতার ভিত্তিতে যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলো নিয়ে এগোতে চান তিনি। তিনি বলেন, 'নতুন বিনিয়োগ, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং ক্লিন এনার্জির মতো ইসু্যতে সহযোগিতার বিষয়ে আমাদের আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছে।' দুর্নীতির বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে লু বলেন, 'সরকারকে স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলতে এবং দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্র বাড়াতে আমাদের অনেক কিছু করার আছে।' সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা সফরের আরেকটি কারণের কথা বলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ভাষায়, বাংলাদেশে করের আওতা কীভাবে বাড়ানো যায়, যার ভিত্তিতে সব বাংলাদেশি তার ভাগের দেনাটা পরিশোধ করতে পারে, সে বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য সম্প্রতি তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এবারের সফরের অভিজ্ঞতাকে 'চমৎকার' বলে বর্ণনা করেন তিনি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্ক আরও গভীর ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ককে বহুমাত্রিক উলেস্নখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অভিযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার এবং সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। মন্ত্রী বলেন, 'আমি অনুরোধ করেছি যে, আমরা যে ৪০টি আইটি ভিলেজ করার পরিকল্পনা করেছি, সেখানে কিছু মার্কিন বিনিয়োগ আছে এবং আরও যাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়। এ ছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যেন আরও মার্কিন বিনিয়োগ আসে, সে বিষয়ে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছি।' পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের বিজনেস বাস্কেটের ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্য যে জিএসপি সুবিধা আমরা পেতাম, কিন্তু এখন পাই না, সেটি তারা ফিরিয়ে দিতে রাজি। আমি বলেছি, আপনারা প্রোগ্রামটা যখন ফের শুরু করবেন, তখন বাংলাদেশকে বিবেচনা করুন। মন্ত্রী বলেন, 'তবে এ জন্য সবার আগে আমাদের শ্রমনীতি পুনঃপর্যালোচনা করতে হবে এবং এটি আমরা করছি। এটি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সোমবার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে বাংলাদেশকে অর্থায়ন করতে চায়।' পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ডোনাল্ড লু জানিয়েছেন, এটি তাদের বিচার বিভাগের অধীনে এবং সেখানে হোয়াইট হাউস বা স্টেট ডিপার্টমেন্টের এখতিয়ার নেই। তবে তারা তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়তা করবে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চায়। আমরাও চাই। নির্বাচন বা মানবাধিকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। উভয়পক্ষ আলোচনা করেছি যে, অতীতে কি ঘটেছে, সেটি আমরা দেখতে চাই না। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই।' পরিবেশ সুরক্ষায় যৌথভাবে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র এদিকে, বুধবার ডোনাল্ড লুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরিবেশ সুরক্ষার নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কীভাবে কাজ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লু। বৈঠকের পর পরিবেশমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। শুরুতেই তিনি বলেন, 'আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছি, অতীতের কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুবিধার্থে এটা আগেই জানিয়ে রাখলাম।' সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশ এবং আমেরিকার মধ্যে যে সম্পর্ক আছে এটাকে আমরা কীভাবে আগামী দিনে এগিয়ে নিতে পারি। সেখানে সার্বিকভাবে যে বিষয়গুলোতে আমাদের অবস্থান অভিন্ন, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং আমেরিকা কীভাবে যৌথভাবে কাজ করতে পারে, মূলত আমরা সেটা নিয়ে আলাপ করেছি। জলবায়ু নিয়ে কথা বলার সময় পরিবেশ, বন ও জীব বৈচিত্র্যের বিষয়গুলো চলে আসে। এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতাকে আগামী দিনে আমরা একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করব। সে জন্য হয়ত আমাদের একটা ওয়ার্কিং গ্রম্নপের মতো কিছু একটা থাকতে পারে। এখানে আমরা পাঁচ বছরের একটা কর্মসূচি হাতে নেব। এই কর্মসূচির অধীনে প্রতিবছর কী কী কাজ হবে, সেটা থাকবে।' পরিবেশমন্ত্রী বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কর্মসূচিতে আমেরিকার প্রাইভেট সেক্টরেরও আগ্রহ রয়েছে। আমাদের যে মুজিব ক্লাইমেট প্রসারিটি পস্ন্যান আছে, এর কিছু অংশে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে।' ভবিষ্যতে পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষায় বিনামূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট ইমেজের সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়েও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে জানান সাবের। 'আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাই' এদিকে, মঙ্গলবার ঢাকায় গুলশানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসায় নৈশভোজে যোগ দেন ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে দুই দেশের মধ্যে যে 'ভুল বোঝাবুঝি' হয়েছে, সেটি দূরে ঠেলে 'আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার' কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের ওই নৈশভোজের পর এক ব্রিফিংয়ে 'অনানুষ্ঠানিক' আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আলোচনায়র্ যাব ও পুলিশের বিশেষ এই ইউনিটের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ওপর বিধিনিষেধ, রোহিঙ্গা, শ্রম আইন নিয়েও কথা হয় বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, 'আমরা চাচ্ছি যে, আমাদের সঙ্গে উনাদের সম্পর্কটা যেন আরও ভালো হয়। উনারা সে কথাটাই বলেছেন। উনি ইংরেজিতে কথাটা বলেছেন যে, উই ওয়ান্ট টু রিবিল্ড দ্য ট্রাস্ট। এটাই হলো-আমার মনে হয়, খুবই উনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, যা বলেছেন। আমরাও প্রতি উত্তরে বলেছি, আমরাও সেটাই চাই। আমরাও একই জিনিস চাই।' তবে নির্বাচনের আগে-পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টানাপড়েন, সেটাকে 'ভুল বোঝাবুঝি' হিসেবে অভিহিত করলেও বিষয়টি আলোচনা ওঠেনি বলে দাবি করেন সালমান এফ রহমান। এর আগে বিকালে ডোনাল্ড লু নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতিবিনিময় সভা করেন। ঢাকার আমেরিকান ক্লাবে এক অনুষ্ঠানেও যোগ দেন তিনি।