শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে পেছনে ছুটছে বিআরটিএ

সাখাওয়াত হোসেন
  ১২ মে ২০২৪, ০০:০০
ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে পেছনে ছুটছে বিআরটিএ

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জাতীয় মহাসড়কে বেপরোয়া গতির যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও লোকবল সংকট ও স্পিডগানসহ প্রয়োজনী অন্যান্য সরঞ্জামাদির অভাবে দীর্ঘদিনেও এ কার্যক্রমে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। অথচ এ বাস্তবতাতেই এবার মহাসড়কের পাশাপাশি জেলা শহরের রাস্তা ও এক্সপ্রেসওয়েতেও মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও বাসের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করে মোটরযানের গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা-২০২৪ জারি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। যা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে তার পেছনে ছোটার মতো বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

তাদের ভাষ্য, গতিসীমা ঠিক করার উদ্দেশ্য সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা। কিন্তু যেভাবে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। তেমনি তা অবকাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ নির্দেশিকা কোনোভাবেই মানানো যাবে না। এতে উল্টো সড়কে আরও বিশৃঙ্খলা বাড়বে। একই লেনে ভিন্ন গতির একাধিক শ্রেণির যানবাহন চললে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ারও প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাসড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে সড়কের পাশে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা স্পিডগান নামের একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন, যেটি গাড়ির টায়ারের দিকে তাক করে রেখে গতি মাপা হয়। কোনো গাড়ি নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সামনে থাকা চেকপোস্টকে গাড়িটির বিষয়ে নির্দেশনা দেন। পরে অপরাধ অনুযায়ী মামলা দেওয়া হয়। এটি ব্যবহার করে গতি তদারকিতে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব।

তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মহাসড়কে গতিসীমার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা ও স্পিডগানের মতো সনাতনী পদ্ধতি ব্যবহার করে গাড়ির বেপরোয়া গতি ও দুর্ঘটনা কোনোটাই কমানো সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ

\হইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর মো. হাদিউজ্জামান বলেন, হাইওয়ে পুলিশের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা আসলে নেই। এর কারণ হচ্ছে লোকবলের ঘাটতি যেমন, তেমনি কারিগরিভাবে তাদের সক্ষমতারও ঘাটতি আছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই ম্যানুয়ালি এভাবে গতির তদারকি করা হয় না।

তিনি জানান, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হাতে রাডার গান ধরে রেখে সনাতনী পদ্ধতিতে গতি নির্ণয় এগুলো এখন আর চলে না। এখন আসলে মহাসড়কের সঙ্গেই প্রযুক্তি সমন্বয় করা থাকে। অনেক দেশে সড়কে রাস্তার সঙ্গে ম্যাগনেটিক সেন্সর থাকে। এটা গাড়ির সংখ্যা, ধরন ও এদের গতি নির্ণয় করতে পারে। এটা দিয়ে যানবাহনের রিয়েলটাইম মনিটরিং করা সম্ভব। অনেক ধরনের সেন্সর দিয়ে এখন রিয়েল টাইম মনিটরিং হয়। রিয়েল টাইম সেন্সর করার পর ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। এর মাধ্যমে চালককেও এই সময়ের মধ্যে সতর্ক করা যায়।

তিনি আরও জানান, 'আমাদের দেশে সাইনবোর্ডে গতির সীমা থাকে। কিন্তু অনেক চালক নিরক্ষর বা অসচেতন হওয়ায় তারা তা বুঝতে পারেন না। এজন্য তারা যাতে গতি কমাতে বাধ্য হন এরকম ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে সড়কের নকশা এমনভাবে প্রণয়ন করা জরুরি যাতে চালক চাইলেও গতি বাড়াতে পারবেন না। এ জন্য রাস্তায় রাম্বল স্ট্রিপ দেওয়া যেতে পারে। চালক যখন এটার ওপর দিয়ে চালাবে তখন ঝাঁকি লাগবে। এটা রাস্তায় কিছুদূর পর পর দেওয়া যেতে পারে। তখন চালক বুঝতে পারবে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আছেন বা ডানে-বাঁয়ে স্কুল আছে ইত্যাদি। আর ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে স্পিড গভর্নর (গাড়ির জ্বালানি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি নিয়ন্ত্রণ) লাগাতে হবে। একটা সুয়ো মোটো রুলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টেরও এরকম একটি নির্দেশনা ছিল।

এদিকে এক্সপ্রেসওয়েতে ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানোর নির্দেশনা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করাই হয় মূলত দ্রম্নতগতিতে গাড়ি চলার জন্য। এ পথে অনায়াসে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানো সম্ভব। সেখানে ৮০ কিলোমিটারে গতিসীমা বেঁধে দেওয়া মানে উন্নয়নের গতিপথে হাইড্রোলিক ব্রেক কষে দেওয়া। এক্ষেত্রে উচ্চ খরচে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। কেননা এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নের সময় উপযোগিতার বিষয়ে বলা হয়েছে, এ প্রকল্প দ্রম্নতগতিতে যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীল করবে।

পাশের দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলছে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে, শ্রীলংকা চলছে ১১০ কিলোমিটার গতিতে। অন্যান্য দেশে ১৪০ কিলোমিটার গতিতেও এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচল করছে। সেখানে দেখা হয় গাড়ি নির্ধারিত গতির লেনে চলছে কিনা।

উন্নত দেশে ডিজিটাল পেস্নটে গতিসীমা লিখে রাখে। সেখানে যে সড়ক সকালে ৮০ কিলোমিটার গতি হয় কখনো কখনো এটা ৫০ কিলোমিটারেও আসতে পারে। কখনো এটা ১১০ কিলোমিটারেও নিতে পারে। এটা তাৎক্ষণিক একদল টেকনিক্যাল লোক বসে নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ নতুন নির্দেশিকায় সড়ক-মহাসড়ক-এক্সপ্রেসওয়ে সবখানেই গাড়ির গতিসীমা নির্দিষ্ট গন্ডিতে বন্দি করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে।

এদিকে মোটরযানের গতিসীমা বিধিমালা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদর/উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৩০ কিলোমিটার, শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ২০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস, হালকা যাত্রীবাহী মোটরযান এবং বাস-মিনিবাস ও ভারী যাত্রীবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদরে ৪০ কিলোমিটার, উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৪০ কিলোমিটার, শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ৩০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাতে হবে। ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ মালবাহী মোটরযান এবং ট্রেইলারযুক্ত আর্টিকুলেটেড মোটরযানের ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিসীমা সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদরে ৩০ কিলোমিটার, উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে ৩০ কিলোমিটার, শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে ৩০ কিলোমিটার রাখতে বলা হয়েছে।

এছাড়া জেলা সড়ক, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদর, উপজেলা মহাসড়ক ও শহর এলাকায় প্রাইমারি আরবান সড়কে চলাচলের অনুমতি সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার গতিতে থ্রি-হুইলার চলতে পারবে। এ ছাড়া শেয়ার রোড ও অন্যান্য সড়ক এবং গ্রামীণ সড়কে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ২০ ও ৩০ কিলোমিটার গতিতে থ্রি-হুইলার চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, গাড়ির গতিসীমা পরিমাপের জন্য হাইওয়ে পুলিশের কাছে যে সংখ্যক স্পিডগান রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের পুলিশ কিংবা ট্রাফিকের কাছে এ ধরনের সরঞ্জামাদি নেই। এমনকি গতি পরিমাপে অন্য কোনো যন্ত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ে গাড়ির গতি পরিমাপ করা হবে কোন উপায়ে। গ্রামীণ সড়কেই বা কে কীভাবে মোটরযানের গতি পরিমাপ করবে?

মোটরযান মালিক ও চালকদের আশঙ্কা, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না নিয়েই নতুন জারিকৃত বিধিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। ট্রাফিক পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাদের হাতে যানবাহন চালকদের অনেক বেশি হয়রানির শিকার হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা সদরে ৩০ কিলোমিটার বেগে মোটরসাইকেল চালালে দ্রম্নত গন্তব্যে পৌঁছানোর বাহন হিসেবে পরিচিত এ যানের ব্যবহার কতটা বাস্তবসম্মত হবে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

রিফাতুল হাসান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী জানান, সড়কের যানজট ঠেলে পিকআওয়ারে মিরপুরের বাসা থেকে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে তার ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। তবে শনিবার রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা থাকলেও ৩০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে তার ১ ঘণ্টা ৭ মিনিট সময় লেগেছে। এভাবে গাড়ির গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হলে গোটা নগরীতে যানজট আরও বাড়বে এবং গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু সড়কে পিকআওয়ারে ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই শিক্ষার্থী।

এদিকে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নতুন বিধিমালা বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, স্পিডগান কিংবা গতি পরিমাপক অন্য কোনো যন্ত্র ছাড়া মোটরযানের মালিক-চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বিশৃঙ্খলা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে এ বিধিমালা জারি করা সমীচীন বলে মনে করেন তারা।

তবে বিআরটিএ বলছে, বিধিমালা জারি করা হলেও তা বাস্তবায়নে 'ধীরে চলো নীতি' গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই বলেও স্বীকার করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর মুখপাত্র মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, নতুন গতিসীমা ধীরে ধীরে কার্যকর করা হবে। এটি ব্যাপকভাবে বাস্তবায়নে সময় লাগবে। নতুন নির্দেশিকা সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য প্রচারণা কর্মসূচি চালানো হবে। এই অন্তর্র্বর্তী সময়কালে গতিসীমা লঙ্ঘন প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবহার করা হবে। এর উদ্দেশ্য চালকদের নতুন গতিসীমা সম্পর্কে জানানো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে