মেয়াদ শেষ হলেও শেষ হয়নি ২ মেগা প্রকল্প

সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতায় ধুঁকছে দেশের বিদু্যৎ খাত

প্রকাশ | ১১ মে ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
দেশে রেকর্ড পরিমাণ বিদু্যৎ উৎপাদন সত্ত্বেও বেড়েছে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ। যার অন্যতম কারণ সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতা। জানা গেছে, চলতি বছর কয়লাসহ বেশকয়েকটি নতুন বিদু্যৎকেন্দ্র চালু হলেও সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতায় বিদু্যৎ পরিবহণ করা যাচ্ছে না। এমনকি চলমান বিদু্যৎ ঘাটতি পূরণে চড়া দামে বন্ধ থাকা তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু হলেও যোগ হচ্ছে না জাতীয় গ্রিডে। এছাড়াও আমদানি বিদু্যৎ পরিবহণেও বিভিন্ন সময় দেখা দিচ্ছে জটিলতা। এদিকে গত এক দশকে দেশের বিদু্যৎ খাতে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মাথায় রেখে উৎপাদন সক্ষমতার পাশাপাশি সঞ্চালণ লাইন, নতুন সাবস্টেশন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অটোমেশন ও দক্ষজনবল তৈরিসহ সামগ্রিক পাওয়ার গ্রিড ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে প্রায় এক লাখ হাজার কোটি টাকার কয়েক ডজন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে এখনও ১৭টি মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এসব প্রকল্পের বেশির ভাগের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সাল নাগাদ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের সিংহভাগই বিদেশি ঋণনির্ভর, তাই যথাসময়ে অর্থছাড় না হওয়ায় অনেক প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ধীর গতিতে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত কিছু প্রকল্পে চাহিদা অনুপাতে অর্থছাড় হয়নি। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে কিছু প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ধীরগতিতে। অন্যদিকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন জটিলতায় কিছু প্রকল্প কাজ শুরু হতেই সময় লেগেছে কয়েক বছর। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্যনুসারে, চলমান ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে কিছু প্রকল্পের মেয়াদ ৭ থেকে ১০ বছরব্যাপী এবং কিছু প্রকল্পের মেয়াদ ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত। সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, অধিকাংশ প্রকল্প শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। এছাড়াও কিছু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৮ সালে। এর বাইরে দুইটি প্রকল্পের একটি চলতি বছর জুন ও অপরটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। এ ছাড়াও যেসব প্রকল্প ২০২৪ সাল নাগদ শেষ হওয়ার কথা, তার অনেকগুলোরই ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কাজ বাকি রয়েছে, যা নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। তবে পিজিসিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী ২ বছরের মধ্যে চলমান প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগেরই কাজ সম্পন্ন হবে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনেক প্রকল্পের অর্থছাড় বাড়িয়েছে, তবে সামগ্রিক অগ্রগতি অনেকটাই নির্ভর করছে বিদেশি সংস্থাগুলোর যথাসময়ে অর্থছাড়ের ওপর। এদিকে চলমান এসব প্রকল্পের মধ্যে চীনা অর্থায়নের 'বিদু্যতের নির্ভরযোগ্য সঞ্চালনের জন্য প্রয়াজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার' এবং বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে 'পূর্বাঞ্চলে পাওয়ার নেটওয়ার্ক বর্ধন ও শক্তিশালীকরণ'; এই দুই প্রকল্পর প্রথমটি আগামী মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫৩ শতাংশ, অন্যটি ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও ১৬ শতাংশ কাজ বাকী, এছাড়া অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ৪৮ শতাংশ। এই দুই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে সার্বিক সঞ্চালণ ব্যবস্থা অনেকটাই পিছিয়েছে রয়েছে। পিজিসিবির তথ্যনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে মেয়াদে গৃহীত দেশের 'পূর্বাঞ্চলে পাওয়ার নেটওয়ার্ক বর্ধন ও শক্তিশালীকরণ' প্রকল্পের অধীনে বৃহত্তর কুমিলস্না, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যমান পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক সক্ষমতা বৃদ্ধি জন্য নেয়া হয়েছিল। এর অধীনে ১২.৬৩ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন, ১৭৫ কিলোমিটারের ২৩০ কেভি ও ১৩২ কেভির ২৫৬ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এছাড়াও ৪০০ কেভি ২৩০ কেভি ভোল্টের দুইটি এবং ১৩০ কেভি ভোল্টের ১০টি সাবস্টেশন রয়েছে। আর এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন তিন হাজার ৬৪২ কোটি টাকা এবং সরকাররের নিজস্ব অর্থায়ন এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও অর্থায়ন হয়ে হয়েছে মাত্র ৪৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৬ সালে নেয়া 'বিদু্যতের নির্ভরযোগ্য সঞ্চালনের জন্য প্রয়াজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার' প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী মাসে। ৮ বছর মেয়াদি জি টু জি আওতায় এতে অর্থায়ন করছে চীনা এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এক মাসের কম সময় বাকী থাকলেও প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৫৩ শতাংশ, এবং অর্থছাড় হয়েছে ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে, ১০০ কিলোমিটার ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন, ৩৩০ কিলোমিটারের ২৩০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন ও ৩৩২ কিলোমিটারের ১৩০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন। এছাড়াও বিদু্যতের নির্ভরযোগ্য সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার করণের লক্ষ্যে চলমান প্রকল্পের আওতায় আরও রয়েছে, বিদ্যমান ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইনের কন্ডাক্টর আপ গ্রেডেশন, একটি করে ৪০০/১৩২ কেভি ও ২৩০/১৩২ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ, বিদ্যমান ২৩০/১৩২ কেভি সাবস্টেশনগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি, নতুন ২৮টি ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ, বিদ্যমান ২৮টি ১৩২/৩৩ সাবস্টেশনের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিদ্যমান ১৪টি ১৩২ কেভি সাবস্টেশনের সংস্কার। এছাড়াও প্রকৌশলীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও পরিচালনায় দক্ষজনবল তৈরির লক্ষ্যে নেয়া আরও একটি প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালে শেষ হলে বর্তমান অগ্রগতি ৫০ শতাংশের কম। এর বাইরে চলমান প্রায় ৫ থেকে ৬টি প্রকল্প রয়েছে যার মেয়াদ ধরা হয়ে এ বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৫ থেকে ১০ বছর মেয়াদি এসব প্রকল্পের বেশির ভাগেরই ৪০ শতাংশের ওপরে কাজ বাকী রয়েছে। ফলে এসব প্রকল্প যথা সময়ে মধ্যে শেষ হওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে। যার মধ্যে একটি প্রকল্প নির্ভরযোগ্য পাওয়ার সিস্টেম ও দক্ষতা উন্নয়ন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ৮ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৯ শতাংশ এবং অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঞ্চালন লাইনের আধুনিকায়ন। যার মধ্যে ১০ কিলোমিটারের ডাবল সার্কিট লাইন, ফরিদপুরের ৩০ কিলোমিটারের ডাবল সার্কিট লাইন, সিস্টেম আপগ্রেডশনসহ পিজিসিবির সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ ৪০০ কেভি ডায়নামিক লাইন রের্টিং প্রবর্তন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রকল্প এ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভবনা নেই। এতে এই অঞ্চলে বিদু্যৎ পরিবহণ ব্যবস্থা কোনো উন্নতি হবে না। এসব বিষয়ে জানতে সংস্থাটির প্রকল্প মনিটরিং প্রধানের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে পিজিসিবির মহাপরিচালক এ কে এম গাউছ মহীউদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে জানান, করোনার কারণে প্রায় ২ বছর বেশির ভাগ প্রকল্প ধীরগতিতে এগিয়ছে, এছাড়াও দেরিতে কাজ শুরু হওয়াসহ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নানা জটিলতা যথাসময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অর্থছাড় ধীরগতিতে হওয়া কিছু প্রকল্প আটকে ছিল। তবে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। আশা করছি আগামী ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পই শেষ হয়ে যাবে।