নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা

আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনের যাবজ্জীবন

মামলার সাক্ষীরা ছিল পক্ষপাতদুষ্ট : আদালত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনসহ ৬ জন খালাস

প্রকাশ | ১০ মে ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ম যাযাদি রিপোর্ট নব্বই দশকের চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকান্ডের ঘটনায় করা মামলায় চলচ্চিত্র প্রযোজক, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনের যাবজ্জীবন আদেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনাল-২ এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী এ রায় ঘোষণা করেন। কারাদন্ডের পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া বাকি ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন। মূল রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা পক্ষপাতদুষ্ট ও সত্য গোপনের চেষ্টা করেছেন।' আর রায় ঘোষণা পর সোহেল চৌধুরীর মেয়ে লামিয়া ইসলাম চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, 'আমার বাবা তো ফেরত আসবেন না। তাদের (আসামিদের) বিচারে আমাদের কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি, হবেও না।' তবে রায় শুনে খালাস পাওয়া আসামিদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন নামে একজন সন্তোষ প্রকাশ \হকরে বলেছেন, 'বিজয় পেয়েছি'। দন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ ও আদনান সিদ্দিকী। খালাস পাওয়া আসামিরা হলেন- সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, আদনান সিদ্দিকী, আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন ও ফারুক আব্বাসী। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনাল-২ এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য বৃহস্পতিবার ধার্য করেন। গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি মামলাটিতে আত্মপক্ষ শুনানি শেষ হয়। এর আগে কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে না আসায় গত ২৮ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করেন আদালত। মামলাটিতে ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় মামলা করেন। সোহেল চৌধুরী নিহত হওয়ার পরপরই এই হত্যাকান্ডে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। আইনজীবী ও আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মামলার অভিযুক্ত ৯ আসামির মধ্যে পাঁচজন পলাতক। তারা হলেন ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন ও আদনান সিদ্দিকী। এ ছাড়া আসামি আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন ও ফারুক আব্বাসী জামিনে আছেন। আর কারাগারে আছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। মামলাটি তদন্ত শেষে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর দুই বছর পর মামলাটির বিচার দ্রম্নত নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার ২ নম্বর দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনালে পাঠানো হয়। ওই বছরই আসামিদের মধ্যে একজন হাইকোর্টে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সাল থেকে দীর্ঘ ১৯ বছর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটি স্থগিত ছিল। অবশেষে বৃহস্পতিবার মামলাটির রায় ঘোষণা হয়। মামলার সাক্ষীরা পক্ষপাতদুষ্ট : আদালত সোহেল চৌধুরী হত্যার মামলার মূল রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, 'যারা পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের অনেকেই মারা গেছেন। তাই তাদের সাক্ষ্য পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আর আসামিদের অনেকে সাক্ষ্য দিতেও আসেননি, এমনকি জবানবন্দি গ্রহণ করা ম্যাজিস্ট্রেটরাও আদালতে আসেননি। যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারাও পক্ষপাতদুষ্ট ও সত্য গোপনের চেষ্টা করেছেন।' পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, 'এই মামলার সিডি (কেইস ডকেট) পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, সিডি গায়েব করা হয়েছে। আসামি আদনান সিদ্দিকী ঘটনাস্থল থেকে ধরা পড়েন। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন, তবে সেটাও অনেকটা গা বাঁচিয়ে দেওয়ার মতো। সোহেল চৌধুরী কোনো অখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না, অথচ তিনি খুন হলেন। ট্রাম্প ক্লাবের ম্যানেজার বলেছেন, জেনেছি সোহেল চৌধুরী নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অথচ এ ঘটনায় আহত অপর একজনকেও হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।' এত বছর ধরে ফেলে রেখে মামলার বিচার না হওয়ায় মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে উলেস্নখ করে বিচারক বলেন, 'প্রতিটি মৃতের আত্মা বিচার চায়। আদনান সিদ্দিকী কয়েকজনের নাম বলেছেন নিজের গা বাঁচিয়ে। যে নিজের গা বাঁচিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে, সে অন্যের নাম সত্য বলতে পারে। তবে যাদের নাম বলছেন, তাদের কাছ থেকে কোনো রিকোভারি হয়নি। তারা যে সেখানে ছিল সেটা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও আদনান সিদ্দিকী যাদের নাম বলছে, তাদের মধ্যে একজনও যদি সেখানে না থাকে বা একজনের নামও অন্তর্ভুক্ত করে থাকে; তাহলে তার ভাষ্য অনুযায়ী আসামিদের গুরুদন্ড দেওয়া ঠিক হবে না।' রায়ে বিচারক আরও বলেন, আসামি আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ ও আদনান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রাপ্ত সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। বান্টির বক্তব্যে ইমন ও আশীষ রায় চৌধুরীর নাম আসলেও ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়নি, বিধায় তাদের খালাস দেওয়া হলো। আমার বাবা তো ফেরত আসবেন না: মেয়ে লামিয়া রায় ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত সোহেল চৌধুরীর মেয়ে লামিয়া চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, '...আমার বাবা তো ফেরত আসবেন না। উনারা (অপরাধীরা) যেটা করেছেন, সেটার জবাব উনাদেরই দিতে হবে। উনাদের যাবজ্জীবন হোক কিংবা যেটাই হোক- বাবার মৃতু্য আমার জীবনে যে প্রভাব ফেলেছে, সেটা কোনোভাবেই পরিবর্তন হবে না। রিয়েলিটি নিয়েই আমাকে থাকতে হবে। এখন তাদের বিচারে আমাদের কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি, হবেও না।' ঢাকাই সিনেমার তারকা জুটি সোহেল চৌধুরী ও দিতির দুই সন্তানের মধ্যে লামিয়া চৌধুরী বড়। ছেলে শাফায়েত চৌধুরী কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে করে ইউরোপে থিতু হয়েছেন। শৈশবেই বাবাকে হারানোর পর মা দিতির কাছেই বেড়ে উঠেছেন লামিয়া ও শাফায়েত। ২০১৬ সালে দিতির মৃতু্যর পর মা-বাবার স্মৃতিচিহ্ন নিয়েই বেঁচে আছেন তারা।