ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে যায়- এমন কিছু না করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'মদ, জুয়া, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো কারও এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে।'
বুধবার রাজধানীর আশকোনায় হজ কার্যক্রম-২০২৪ (১৪৪৫ হিজরি) উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'ইসলাম একটি পবিত্র ধর্ম, যা সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক জঙ্গি কর্মকান্ড চালিয়ে ইসলামের বদনাম করে। আমি সব সময় এর প্রতিবাদ করি।'
অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'দেশে সব ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম পালনের সমান অধিকার ভোগ করবে।'
'ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণেই
ঘরে বসে হজের কাজ সম্পন্ন'
ডিজিটাল বাংলাদেশ করায় হয়রানি ছাড়াই ঘরে বসে হজের সব কাজ করা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, 'আজকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ঘরে বসেই হজের কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ২০০৮ এর নির্বাচনের ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছিলাম।
আজকে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। বাস্তবায়ন হয়েছে বলে এই সুযোগটা আপনারা সবাই পেয়েছেন। ঘরে বসে সব কাজ করতে পারেন। কোনোরকম হয়রানির শিকার হতে হয় না। হজের রেজিস্ট্রেশন সরাসরি অনলাইনে করা যায়, সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। ডিজিটাল সেন্টার করে দিয়েছি, সেখানেও রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জন্য এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'বাঙালি জাতি এক সময় দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত ছিল। এক সময় চিন্তাই করতে পারত না বা সেই সঙ্গতিও অর্জন করতে পারেনি। স্বাধীনতার অর্জনের ফলেই আজকে সেটা সম্ভব হয়েছে।'
প্রধানমন্ত্রী হজযাত্রীদের কাছে দেশ ও জাতির জন্য দোয়া চেয়ে বলেন, 'সরকার হাজিদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধাসহ হজ ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছে, সেটা ধরে রেখে যেন এটাকে আরও উন্নত করতে পারে, সে দোয়াটা আপনারা করবেন। দেশের মানুষের জন্য দোয়া করবেন। মহান আলস্নাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের মানুষের জন্য গোলা ভরা ধান দেন, পুকুর ভরা মাছ দেন, সুন্দর-উন্নত জীবন দেন, সেই দোয়া করবেন।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি এটুকু বলব যে আজকে আমরা হজ ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করেছি, প্রতিবারই যারা যাচ্ছেন, যেকোনো সমস্যা হচ্ছে সেটাকে আরও উন্নত করার পদক্ষেপ নিচ্ছি। আর এক্ষেত্রে সৌদি সরকার সবসময় আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।' তিনি সৌদি বাদশাহ এবং ক্রাউন প্রিন্সকে এ জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, 'আজকে মালপত্র নেওয়া বা ওখান থেকে মালপত্র নিয়ে আসা বা জমজমের পানি নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। মক্কা-মদিনায় হজ অফিস স্থাপন করাসহ জেদ্দায় আলাদাভাবে টার্মিনালে জায়গা ভাড়া নিয়ে আমাদের হাজিরা যাতে সেখানে গিয়ে অবস্থান করতে পারেন সেই ব্যবস্থাটাও করেছি। আমরা যখন সরকারে এসেছি তখন থেকেই এই ব্যবস্থাটা নিয়েছি এবং প্রতি বছর টার্মিনালে এই ব্যবস্থাটা আমরা রাখি। কারণ আগে যাত্রীদের এখানে সেখানে ফুটপাতে বসে থাকতে হতো।'
আধুনিক হজ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে উলেস্নখ করেন।
'ফিলিস্তিনিরা আরব ভূখন্ডে জায়গা
পাবেন, এটা তাদের অধিকার'
সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'আপনারা জানেন ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে। সেখানে যেভাবে গণহত্যা চালানো হচ্ছে, নারী শিশু কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। আমি যেখানেই কথা বলছি, সেখানে প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। ফিলিস্তিনিরা আরব ভূখন্ডে তাদের জায়গা পাবেন। এটা তাদের অধিকার। এ অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। সেই অধিকার তাদের দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'বিশ্বের সব মুসলিম দেশ একসঙ্গে কাজ করলে, ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবসহ মুসলিমদের জন্য আরও ভালো অবস্থানে পৌঁছানো সহজ হতো। আজ যদি আমাদের সব মুসলিম দেশ এক হয়ে একযোগে কাজ করতে পারত, তাহলে আমরা এ বিষয়ে আরও অগ্রগামী হতে পারতাম।'
ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তিনি নিজেকে একমাত্র বোন (সরকারপ্রধান) হিসেবে উলেস্নখ করে বলেন, 'আমার এখানে একটাই কথা। সবাই এক হন এবং এ ধরনের অন্যায় অবিচার যেন আমাদের ওপর না হয়, সেটা সবাই লক্ষ রাখবেন।'
১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে জাতির পিতার ভাষণেরও উদ্ধৃতি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। জাতির পিতা বলেছিলেন, 'আরব ভাইদের ওপর যে নিদারুণ অবিচার হয়েছে অবশ্যই তার অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরব ভূমি অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। জেরুজালেমের ওপর আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।'
তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, 'কাজেই জেরুজালেমে মুসলমানদের যে অধিকার, এটা প্রতিষ্ঠা করার কথাও জাতির পিতাই তার বক্তব্যে বলেন। আপনারা দেখছেন ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। সেখানে নারী ও ছোট ছোট শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই তাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য ও সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর জন্য আপনারা (হজযাত্রী) দোয়া করবেন।'
ধর্মমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী ও বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ ঈসা আল দুহাইলান বক্তৃতা করেন।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দারও বক্তৃতা করেন। দুজন হজযাত্রী অনুষ্ঠানে নিজস্ব অভিব্যক্তিও প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ২০২৪ সালের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি অডিও ভিজু্যয়াল পরিবেশনা প্রদর্শিত হয় এবং শেষে দেশ-জাতি ও হজযাত্রীদের সার্বিক মঙ্গল কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
প্রসঙ্গত, এ বছর মোট ৮৫ হাজার ২৫৭ বাংলাদেশি হজ পালন করতে পারবেন। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৫৬২ জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং বাকি ৮০ হাজার ৬৯৫ জন ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করবেন। বৃহস্পতিবার থেকে হজ ফ্লাইট চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথম হজ ফ্লাইট (বিজি-৩৩০১) ৪১৯ জন যাত্রী নিয়ে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে যাত্রা করবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাজ্যের
সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
এদিকে, যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান বুধবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোরপূর্বক বাস্তুচু্যত করা রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাজ্যের (ইউকে) প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য আপনার পদমর্যাদা ব্যবহার করুন।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।'
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার এম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
ট্রেভেলিয়ান কক্সবাজার ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের বিষয়গুলো উত্থাপন করলে শেখ হাসিনা বলেন, 'ক্যাম্পে মানুষের ভিড় অনেক বেশি হওয়ায় সেখানে এসব সুবিধা নিশ্চিত করা অসম্ভব।' তবে তিনি বলেন, 'তার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর দ্বীপে সব সুযোগ-সুবিধাসম্বলিত ঘর নির্মাণ করেছে। ভাসানচরে এসব সুযোগ-সুবিধার মধ্যে আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।'
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনকে বাংলাদেশে আরও বেশি পরিমাণে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, 'পারস্পরিক সুবিধার জন্য সরাসরি বিনিয়োগের করতে বাংলাদেশে স্থাপিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্রিটেনকে জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি।'
ব্রিটেনে অবস্থানরত অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্রিটেনের সঙ্গে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) স্বাক্ষর করতে পারে। তিনি বলেন, 'আমরা চাই কেউ অবৈধভাবে বিদেশে না যাক এবং আমরা এ লক্ষ্যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি।'