মিল্টন সমাদ্দারের বিতর্কিত কর্মকান্ড তদন্তে মাঠে নেমেছে পাঁচ সংস্থা। ডিবি পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তে নানাভাবে সহায়তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ইতোমধ্যে বিটিআরসি মিল্টনের বিতর্কিত শতাধিক ভিডিও কনটেন্ট মুছে ফেলেছে। বাকিগুলো মুছে ফেলার কাজ চলছে। এদিকে মিল্টনের আশ্রমে থাকা অসহায় ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শামসুল হক ফাউন্ডেশন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মিল্টন সমাদ্দারের বিতর্কিত কর্মকান্ডের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে এসেছে। এ ছাড়া মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশের তরফ থেকেও মিল্টনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে তদন্তকারী সংস্থার তরফ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তারই আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো সচল রয়েছে। যেটি সত্যিই একটি ভয়ের ব্যাপার। কারণ এসব অ্যাকাউন্টে দাতারা অর্থ সহায়তা করলে, প্রতারিত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এজন্য অ্যাকাউন্টগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন,
মিল্টন সমাদ্দারের অ্যাকাউন্টে সোমবার পর্যন্ত ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা থাকার তথ্য মিলেছে। অ্যাকাউন্টগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
মিল্টন সমাদ্দার ইসু্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যাংকটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংককে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।'
তিনি আরও বলেন, 'মূলত মিল্টন সমাদ্দারের অর্থ সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফইউ) তদন্ত করছে। বিএফইউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন হলেও বর্তমানে আলাদা সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এই সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানিলন্ডারিং ইউনিট, দুদক ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সম্মিলিতভাবে তদন্ত করছে।'
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, মিল্টন সমাদ্দারের মানিলন্ডারিং বা অর্থ সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এ সংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করবে সিআইডির মানিলন্ডারিং টিম। আর অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ বা স্থাবর-অস্থাবর সহায়-সম্পত্তির বিষয়টির অনুসন্ধান করছে দুদক। সম্মিলিত তদন্তে মিল্টন সমাদ্দার দোষী প্রমাণিত হলে তার সাজা নিশ্চিত করার জন্য আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করবে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহ্সান যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিতর্কিত ব্যক্তি মিল্টন সমাদ্দার ইসু্যতে আমাদের তরফ থেকে তদন্তে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত আছে। বিটিআরসিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা মিল্টন সমাদ্দারের বিতর্কিত সব কনটেন্ট মুছে ফেলতে বলা হয়েছে।'
বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনার পর পরই বিষয়টি বিটিআরসির নজরে এসেছে। কিন্তু সংস্থাটি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংগঠনের কনটেন্ট মুছে ফেলতে পারে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তদন্তকারী সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা ওইসব কনটেন্টের বিষয়ে অভিযোগ করেন। মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার হওয়ার পর পরই এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এসেছে। সেই নির্দেশনা মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে অদ্যাবধি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া মিল্টন সমাদ্দারের বিতর্কিত অন্তত শতাধিক কনটেন্ট মুছে ফেলা হয়েছে। বাকিগুলো মুছে ফেলতে সম্মিলিতভাবে কাজ চলছে।
বিষয়টি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে বিটিআরসির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ খলিল-উর-রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া বিতর্কিত মিল্টন সমাদ্দারের কনটেন্ট মুছে ফেলার কাজ অব্যাহত আছে। অত্যন্ত দ্রম্নততার সঙ্গে তা করা হচ্ছে। মিল্টন সমাদ্দার ইসু্যতে দায়েরকৃত মামলায় বিটিআরসির তরফ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এদিকে সোমবার ঢাকার মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ জানান, মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে থাকা অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুদের দায়িত্ব নিয়েছে শামসুল হক ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মিল্টনের আশ্রমে থাকা অসহায় ব্যক্তিদের সেখানে রেখেই খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবা দিচ্ছে সংগঠনটি। ইতোমধ্যে চিকিৎসক ও নার্স ছাড়াও প্রয়োজনীয় সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে সংগঠনটির তরফ থেকে।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দারের কাছ থেকে ভয়াবহ ও লোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মাদকাসক্ত মিল্টন মানুষের হাত-পা কেটে পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে অসহায় বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে তাদের দেখিয়ে ভিডিও বানিয়ে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিতেন। অথচ যাদের দেখিয়ে টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিতেন, তাদের পেছনে সেই অনুপাতে খরচ করতেন না।
ডিআইজি হারুন-অর-রশীদ বলেন, আশ্রমে অসুস্থ হওয়াদের চিকিৎসার নামে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলতেন মিল্টন সমাদ্দার ও তার সহযোগীরা। মিল্টন সমাদ্দার একজন মানসিক রোগী। এ ধরনের মানুষ কোনোভাবেই মানবতার ফেরিওয়ালা হতে পারেন না। মিল্টন তার টর্চার সেলে আশ্রমে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে পেটাতেন। বেস্নড বা ছুরি দিয়ে নিজেই অপারেশন করতেন। অসুস্থদের টর্চার সেলে নিয়ে তাদের বানর বলে আখ্যায়িত করতেন। পেটাতে পেটাতে মানুষকে নিস্তেজ করে ফেলে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন বলে মিল্টন নিজেই স্বীকার করেছেন। টর্চার সেল থেকে নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠিসোটাসহ অন্য জিনিসপত্র আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। জব্দ হয়েছে অপারেশনে ব্যবহৃত ছুরি ও বেস্নড।
প্রসঙ্গত, গত ১ মে রাতে ঢাকার মিরপুর মডেল থানাধীন দক্ষিণ পাইকপাড়ার ৮ নম্বর সড়কের ৪৬২ নম্বর দোতলা বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত 'চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার' সেন্টার থেকে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারের পরপরই তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় ৩টি মামলা হয়। যার মধ্যে একটি মামলার বাদী পুলিশ। অপর দুইটি মামলার বাদী ভুক্তভোগী দুইজনের পরিবার। প্রথম দফায় মিল্টন সমাদ্দারকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় মানব পাচার মামলায় রোববার তাকে আবারও ৪ দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি পুলিশ। রিমান্ডের আবেদনে মিল্টন আশ্রমে থাকাকালে মৃতু্যবরণ করা ৫০ জনের জাল ডেথ সার্টিফিকেট (মৃতু্য সনদ) তৈরি করেছেন বলা হয়েছে।