বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

প্রয়োজনে কাজে আসছে না তেলভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্র

রেজা মাহমুদ
  ০৭ মে ২০২৪, ০০:০০
প্রয়োজনে কাজে আসছে না তেলভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্র

গত দুই যুগে দেশে বিনিয়োগকৃত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম বিদু্যৎ খাত। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে বিদু্যৎ উৎপাদনে সক্ষমতা তৈরিতে। আর এই সক্ষমতার এক চতুর্থাংশই তেলভিত্তিক। কিন্তু বর্তমান বিদু্যৎ সংকটে এসব কেন্দ্র কোনো কাজেই আসছে না। ফলে দেশব্যাপী বিদু্যতের ঘাটতি বেড়েই চলছে। অথচ উৎপাদনে না থাকা এসব কেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর সরকারের ব্যয় হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।

যদিও গত কয়েক দিনে বেশকিছু তেলভিত্তিক কেন্দ্র শর্ত সাপেক্ষে উৎপাদনে ফিরেছে, কিন্তু ট্রান্সমিশন লাইনের দুর্বলতার কারণে তা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যায়নি। এছাড়ও বন্ধ রয়েছে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো।

এদিকে এবার গ্রীষ্মে বিদু্যতের চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে চাহিদা ৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো বেড়েছে। ফলে মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৭০ শতাংশের বেশি বিদু্যৎ কেন্দ্র চালুর প্রয়োজন পড়েছে। তাই গ্যাস, কয়লা ও আমদানির বিদু্যতের পাশাপাশি প্রয়োজন পড়ছে তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালুর। কিন্তু নানামুখী জটিলতায় তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালু করতে পারছে না বিদু্যৎ বিভাগ।

এ বিষয়ে বিদু্যৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান সম্প্রতি যায়যায়দিনকে বলেছেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেশের বিদু্যৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে তেলভিত্তিক বিদু্যৎ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে কিছুটা হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদু্যৎ সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে তাদের বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি জ্বালানি

সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হবে'।

বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) উৎপাদন বিভাগের প্রধান ওয়াজেদ আলী যায়যায়দিনকে বলেন, আপাতত শর্ত সাপেক্ষে বেসরকারি খাতের বেশ কিছু তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। তবে জাতীয় গ্রিডে এর সরবরাহ নেই। স্থানীয় পর্যায়ে এসব বিদু্যৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। মূলত ট্রান্সমিশন লাইনে চাপ এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এসব কেন্দ্র দিনে অর্ধেক সময় চালু থাকছে।

জানা গেছে মে মাসের শুরুতেই বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্রের মালিকদের সঙ্গে বিপিডিবি'র চেয়ারম্যান বৈঠক করেছেন, সেখানে আইপিপি কেন্দ্রগুলো ১২ ঘণ্টা বিদু্যৎ উপাদনে সম্মত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে জাতীয় গ্রিডে এই বিদু্যৎ সরবরাহ না হওয়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী বিদু্যৎ সরবরাহ করতে পারছে না বিদু্যৎ বিভাগ। ফলে বিদু্যৎ উৎপাদন সত্ত্বেও এর শতভাগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে ঢাকার বাইরে লোডশেডিং পরিস্থিতি কোনো পরিবর্তন হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রান্সমিশন লাইনে এমনিতেই অনেক চাপ রয়েছে। এছাড়াও প্রচন্ড গরমে অনেক সিস্টেম ফল্ট করছে। সিলেটে বস্নাক আউটের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদু্যৎ আপাতত স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ হচ্ছে।

দেখা গেছে গত ৪ মে দেশে ১৭ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা বিপরীতে ১৫ হাজার ২২৯ বিদু্যৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদু্যৎ এসেছে তেল থেকে তবে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ না করতে পারায় এই বিদু্যৎ স্থানীয় পার্যায়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এদিকে সরবরাহকৃত তেল বিদু্যতের মধ্যে শতভাগই ফার্নেস অয়েল। ডিজেলের দাম বেশি থাকায় কেবল ফার্নেস অয়েলেই বিদু্যৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে ৩২টি তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্র থাকলেও বিদু্যৎ সুবিধা পাচ্ছে সীমিত কিছু অঞ্চল।

এদিকে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ৮০ শতাংশ বেসরকারি খাতের এবং এসব কেন্দ্রের বিপুল বয়েকা ও জ্বালানি সরবরাহে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। এছাড়াও তেল বিদু্যতে ৩ গুণ বাড়তি ব্যয় এবং দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় রয়েছে টেকনিক্যাল জটিলতাও। ফলে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা থাকা সত্ত্ব্বেও উৎপাদন হচ্ছে গড়ে ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো।

বিদু্যৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট সক্ষমতার ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট অর্থাৎ ২৭ শতাংশ জ্বালানি তেল (ডিজেল ও ফর্নেস) নির্ভর। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের (আইপিপি) ৩২ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৪ হাজার ৩৬২ মেগাওয়াট। বর্তমানে তেলের মোট সক্ষমতার মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাশং উৎপাদনে রয়েছে। যার পুরোটাই সরকারি খাতের। কিন্তু বন্ধ রয়েছে আইপিপি'র ৭৮ শতাংশ। জানা গেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এসব কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। মূলত তেলে দাম বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে আমদানি করতে না পারায় এসব কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়।

এম শামসুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, 'পরিকল্পনা ও প্রতিযোগিতাহীন বেসরকারিভাবে বিদু্যৎ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় এই বিশাল সক্ষমতা কোনো কাজে আসছে না। উল্টো তাদের ভরণ-পোষণের ব্যয় মেটাতে হিমিশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। বাড়ছে ভর্তুকির পরিমাণ, আর এই ভর্তুকি কমাতে বাড়ানো হচ্ছে বিদু্যতের দাম। দিন শেষে পুরো ব্যয়ের বোঝা বইতে হচ্ছে জনগণকে'।

অন্যদিকে বসে থাকা বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোকে সক্ষমতার চার্জ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি রেন্টাল বিদু্যৎ কেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে সম্প্র্রতি জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে