সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রাম উপকূলে বাড়ছে তাপপ্রবাহের হার। পাশাপাশি উষ্ণ বায়ুপ্রবাহের কারণে চট্টগ্রামে বাড়ছে রাতের তাপমাত্রাও। নগরীর এমন ৪৫ শতাংশ এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিল্ড-আপ এরিয়া হিসেবে। সে তুলনায় সবুজ গাছপালা বেষ্টিত এলাকায় তাপপ্রবাহ অনেক কম।
দুই পৃথক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। গবেষকরা মনে করছেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণের কারণে চট্টগ্রামে একাধিক আরবান হিট আইল্যান্ড তৈরি হচ্ছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপ অনুভূত হচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে চিরাচরিত ঋতুবিন্যাস।
ক্রমবর্ধমান এই তাপমাত্রার কারণে বেড়েছে হিটস্ট্রোক এবং ত্বকের ক্যানসারের মতো রোগ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধরা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শিগগির পরিণত হবে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া এলাকায়।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ গবেষক তাদের এক গবেষণায় চট্টগ্রাম শহরের ওয়ার্ডভিত্তিক তাপপ্রবাহের মাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। ওই গবেষণায় রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে ১৭টি শারীরিক ও আর্থ-সামাজিক দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বহুতল ভবনগুলো ঘিরে হিট ওয়েভ বেশি কার্যকর। ফলে নগরে দিন-রাতে প্রায় সমান তাপ অনুভূত হচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরের ৭টি ওয়ার্ড তাপপ্রবাহের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া তিনটি ওয়ার্ড চিহ্নিত করা হয়েছে উষ্ণতার জন্য হটস্পট হিসেবে। চট্টগ্রাম নগরের হটস্পট হলো ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া
ওয়ার্ড, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড ও ২০ নম্বর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড।
এ ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো-পশ্চিম ষোলশহর, দক্ষিণ কাট্টলী, সরাইপাড়া, লালখান বাজার, পশ্চিম বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া ও পশ্চিম মাদারবাড়ী ওয়ার্ড। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডে তাপমাত্রা বাড়ার তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
তথ্যে বলা হয়েছে, বোয়ালখালী উপজেলা ও বাকলিয়া ওয়ার্ডের দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। এই দুই এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। কিন্তু এই দুই এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ বোয়ালখালীতে যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রা বিরাজ করছে, দক্ষিণ বাকলিয়ার বাসিন্দারা তখন গরমে অতিষ্ঠ।
এভাবে গত তিন দশকে পাহাড়, নদী-লেক আর সাগরঘেরা এক সময়ের সবুজ শহর চট্টগ্রামের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে এক দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম পরিণত হচ্ছে হিট আইল্যান্ডে।
চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল পস্নানিং বিভাগ ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান এসব গবেষণা পরিচালনা করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এই গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তিনি।
গবেষণা প্রবন্ধে তিনি উলেস্নখ করেন, প্রায় তিন দশক ধরে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও উপকূলীয় এলাকায় তাপপ্রবাহের মাত্রা বাড়ছে। এসব কারণে চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে রাতের তাপমাত্রা। এ সময়ে ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামে রাতের তাপমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ঢাকায় যেখানে বেড়েছে শূন্য দশমিক ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চট্টগ্রামে সেখানে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গবেষণায় গত ২০ বছরের (২০০০-২০২০) ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দিনের বেলায় গ্রামের সঙ্গে ঢাকার তাপমাত্রার গড় পার্থক্য ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এ সময় চট্টগ্রামের পার্থক্য এক দশমিক ৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু রাতে ঢাকায় তাপমাত্রার পার্থক্য এক দশমিক ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও চট্টগ্রামে তা এক দশমিক ৯০ ডিগ্রি। অর্থাৎ চট্টগ্রামে দিন এবং রাতের তাপমাত্রায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
এ ছাড়া ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার দৈনিক উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বছরে ১৫ দিনের বেশি দাবদাহ ছিল এমন জেলাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম। চট্টগ্রাম ছাড়াও তাপপ্রবাহ বাড়ছে এমন উপকূলীয় এলাকাগুলো হলো- কক্সবাজার, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা।
চট্টগ্রামে রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান বলেন, গত কয়েক দশক ধরে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বাড়ছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সাগর থেকে ভূ-ভাগে প্রবেশ করছে উষ্ণ বায়ু।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে রাতের বেলায় শহরে জনসংখ্যার উপস্থিতি, কলকারখানার কার্যক্রম ও অতিরিক্ত মনুষ্য কর্মকান্ডের ফলে চট্টগ্রামে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রামে যেসব এলাকায় গরম বেশি :
চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরে সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয় বাকলিয়া ও মাদারবাড়ী এলাকায়। গবেষণার সময়ে এ দুই এলাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। গ্রামের তুলনায় চট্টগ্রাম শহরের এই অংশের তাপমাত্রার পার্থক্য ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ ছাড়া নগরীর আগ্রাবাদ, কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম বন্দর, কাট্টলি, লালখান বাজার ও পাঁচলাইশ এলাকায় গ্রামের তুলনায় ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি। সবমিলিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রায় ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ অঞ্চল উচ্চ তাপপ্রবাহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
এ ছাড়া উচ্চ এবং মাঝারি শ্রেণির ঝুঁকিতে রয়েছে যথাক্রমে ২৬ দশমিক ৪০ ও ২৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ এলাকা। দিনে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে গ্রামের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পার্থক্য হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে রাতে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে গ্রামের সবচেয়ে বেশি (৩ দশমিক ১৪ ডিগ্রি) তাপমাত্রার পার্থক্য হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে রাতে সবচেয়ে বেশি (২ দশমিক ৪০ ডিগ্রি) তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান বলেন, চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায় মানুষের। উপকূলবর্তী এই শহরের সবুজ সব পাহাড় ছিল রক্ষাকবচ, গত দুই দশকে যা নির্মমভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বৃষ্টি যেমন কমেছে, তেমনই জলাধার ভরাটের মাধ্যমে সারফেস ওয়াটারের ক্ষেত্রগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল পস্ন্যানিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দেবাশীষ রায় রাজ বলেন, আরবান হিট আইল্যান্ড হলো কোনো শহরের সেই এলাকা, যেখানে মানবসৃষ্ট কারণে আশপাশের এলাকার তুলনায় উষ্ণতা বেশি। গস্নাস কোডেড বিল্ডিং, ভবনের ছাদ, পিচঢালাই সড়ক কিংবা ঢালাই করা এলাকা উন্মুক্ত মাটির তুলনায় বেশি তাপ ধরে রাখে। যেসব এলাকায় গাছপালা ও জলাশয় কম এবং যন্ত্রচালিত যানবাহন বেশি- সেসব এলাকায় হিট আইল্যান্ড তৈরি হয়। এ ছাড়া মানুষের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থাও গরমের তীব্রতার সঙ্গে জড়িত বলে উলেস্নখ করেন দেবাশীষ রায় রাজ।