হাঁসফাঁস গরম থেকে কি এ বার মুক্তি! বৈশাখের শেষ ভাগে কি মিলবে স্বস্তি! আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অন্তত তেমনটাই বলছে। গত কয়েক দিন ধরে দেশে যে তীব্র দাবদাহ চলছিল, তা শেষের দিকে। আজ থেকে আগামী ৬-৭ দিন ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে তাপমাত্রা। সঙ্গে রয়েছে দেশের সব বিভাগে কালবৈশাখী ঝড়, বজ্রপাত ও বিচ্ছিন্নভাবে শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মলিস্নক জানান, রোববার বিকাল থেকে বুধবার বিকাল ৪টার মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চিম অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দমকা বা ঝোড়োহাওয়াসহ কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যেতে পারে। এ সময় কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাত ও বিচ্ছিন্নভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
আরেক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সোমবার (আজ) সকালে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝোড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে, সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও
বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু কিছু জায়গা থেকে প্রশমিত হতে পারে। ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে এবং অন্যত্র তা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝোড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে, সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝোড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। বর্ধিত পাঁচ দিনে সারা দেশে বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে, দেশে যত দুর্যোগ হয়, তার মধ্যে মে মাসে হয় সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মে মাসজুড়ে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি প্রবল বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টির ও তীব্র কালবৈশাখী হাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত কালবৈশাখীর সময় বেশি বজ্রপাত ঘটে। বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তন। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। উত্তরে রয়েছে পাহাড় ও হিমালয়। সাধারণত বর্ষা আসার আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাগর থেকে আসে গরম বাতাস, আর হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস। একসঙ্গে দুই রকমের বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রমেঘের আবহ তৈরি হয়। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত ঘটে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, মে মাসের শুরুর দুদিনে দেশে ছয় জেলায় বজ্রপাতে অন্তত ২৩ জনের মৃতু্য হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার একদিনে ১১ জন ও গতকাল রোববার ৫ জনের মৃতু্য হয়েছে।
তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, অধিক ধাতব পদার্থের ব্যবহার, মোবাইল ফোন ব্যবহারের আধিক্য এবং এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি ও উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে বজ্রপাতে মৃতু্যর ৯৮ শতাংশই ঘটেছে বাইরে খোলা আকাশের নিচে থাকার কারণে। বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই কৃষক ও জেলে।
আবহাওয়াবিদ ড. মোহাম্মদ আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, ৫ মে থেকে বজ্রবৃষ্টির তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ৬ তারিখ থেকে আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। পাঁচ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও বজ্রসহ বৃষ্টি হবে। এ সময় বজ্রপাতে মানুষের মৃতু্য বাড়তে পারে বলে ঝুঁকি রয়েছে। বিডবিস্নউওটির প্রধান আবহাওয়া গবেষক খালিদ হোসেন বলেন, একটি তীব্র বজ্রপাত যুক্ত বৃষ্টিবলয় দেশের দিকে ধেয়ে আসছে। এই বৃষ্টি বলয়ে দেশের অনেক এলাকায় প্রবল কালবৈশাখী বজ্রঝড় ও শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে শক্তিশালী প্রবল কালবৈশাখী ঝড়ের সম্ভাবনা আছে।
দেশে বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যায় ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কৃষক ও জেলের সংখ্যাই বেশি। বজ্রপাতে বিপুলসংখ্যক গবাদি পশু মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বেশি মৃতু্যর জন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম এক গবেষণায় জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতের প্রবণতাও বাড়ছে। বড় বড় বিল্ডিং থাকায় বজ্রপাতে শহরগুলোতে মৃতু্য কম, গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃতু্য বেশি। আগে তালগাছ বজ্রপাত ঠেকাতো। এখন তালগাছ ও উঁচু গাছ নেই। বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার অর্ধেকই বাংলাদেশে। বজ্রপাতে বিপুলসংখ্যক গাছপালার ক্ষতি ও গবাদিপশু মারা যায়। বজ্রপাতে মৃতু্যর চেয়ে বেশি মানুষ আহত হন। বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা বা ওষুধ নেই দেশের হাসপাতালগুলোতে। বজ্রপাতে এক জনের মৃতু্য হলে অন্তত দশ থেকে পনের জন আহত হয়ে থাকেন। আহতদের প্রতিবন্ধী জীবনযাপন করতে হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। বজ্রপাত ঠেকাতে ১০ কোটি তাল গাছ লাগানোর প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। এরমধ্যে ১০ বছরে ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর পর দেখা যায়, দেখভাল ও যত্নের অভাবে তাল গাছ মারা যাচ্ছে। আর একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। তাই এ প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে সরকার।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আহসান করিম বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে দশমিক ৭৪ শতাংশ তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যই বাড়ছে বজ্রপাত। মে মাসে হাওড় অঞ্চল, যশোর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। তাই এই সময়টায় এসব অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত হয়। অসচেতনতার কারণে মাঠে থাকা কৃষক ও জেলেরা বেশি মারা যাচ্ছেন।
সচেতনতাই পারে মৃতু্য ঠেকাতে
বজ্র্রপাত থেকে রক্ষা পেতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বজ্রপাত সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরে বা বাসা বাড়িতে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। রাবারের জুতা পরা, বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ অথবা উঁচু স্থানে না থাকা। এই সময়ে ধান ক্ষতে বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা। বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে যত দ্রম্নত গাছপালা ও বৈদু্যতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ীর ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না, সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোন কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দার থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতরে বৈদু্যতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। এই সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন। বজ্রপাতের সময় ছাউনবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যাওয়া। কোন বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে থাকা ভালো। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় হাঁটার দূরত্ব ভেদে ইটের অস্থায়ী ঘর তৈরি করতে হবে। যেখানে কৃষক ও মাঠে কাজ করা মানুষ কিছু সময় সুরক্ষার জন্য দাঁড়াতে পারেন। বজ্রঝড় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় থাকে না। মাঠে যারা কাজ করেন তারা যদি ওই সময়টা পাকা ঘরে আশ্রয় নিতে পারেন তাহলে মৃতু্যহার কমানো সম্ভব হবে।
মোবাইলের মাধ্যমে বজ্রপাতের আগে মানুষকে এসএমএস পাঠিয়ে সতর্ক করা যায়। এমন পদক্ষেপ নিয়ে ভারতের কর্ণাটক সফল হয়েছে। ভারতের কর্ণাটকে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট আগে সতর্কতামূলক এসএমএস দেওয়া হচ্ছে। ভিয়েতনামে টাওয়ার স্থাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতে মৃতু্য কমিয়ে আনা হয়েছে।। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন পদক্ষেপে বজ্রপাতে মৃতু্যর হার ৯০ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। বজ্রপাত কমিয়ে আনতে গাছ রোপণের পাশাপাশি বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ এবং ছাদে বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন করতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন 'ডিজাস্টার ফোরাম'-এর তথ্য মতে, দেশে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২৬৩ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন এবং ২০২১ সালে ৩৬৩ জন, ২০২২ সালে ২৭৯ জন, ২০২৩ সালের বজ্রপাতে মৃতু্য হয় ৩৪০ জনের।