গাজীপুরের জয়দেবপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের পর থেকে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনের সূচিতে বড় ধরনের গড়বড় দেখা দিয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। শুক্রবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে জয়দেবপুর স্টেশনের অদূরে উত্তরবঙ্গগামী তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে ঢাকাগামী টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের সংঘর্ষ হয়।
তার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে পাশের লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়ায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি বলে জানিয়েছেন জয়দেবপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ মিয়া।
এদিকে শনিবার সকালে সরেজমিনে জয়দেবপুর জংশনে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলার শত শত যাত্রী গন্তব্যে যাওয়ার
জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনে অপেক্ষা করছেন।
স্টেশনের পস্ন্যাটফর্মে কথা হয় রাজশাহী যেতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকা গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্ময়ের সঙ্গে।
তন্ময় বলেন, 'বন্ধুকে নিয়ে রাজশাহী যাব। সেজন্য টিকিট কেটে সকাল পৌনে ৭টা থেকে ট্রেনের অপেক্ষায় জয়দেবপুর জংশনে বসে আছি। কিন্তু সকাল ১০টার দিকেও ট্রেনের দেখা মেলেনি।'
জামালপুরগামী তিস্তা ট্রেনের জন্য জয়দেবপুর জংশনের পস্ন্যাটফর্মে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসেছিলেন আরেক যাত্রী রনি।
উত্তরার একটি বায়িং হাউসে কাজ করা এই যাত্রী বলেন, 'গ্রামের বাড়ি জামালপুর যাব, সেজন্য পরিবার নিয়ে সকাল সকাল স্টেশনে এসেছি। কিন্তু সাড়ে ৭টার তিস্তা এক্সপ্রেস সকাল ১০টায়ও স্টেশনে পৌঁছেনি। পরিবার নিয়ে কি যে ভোগান্তিতে পড়েছি।'
জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনের সিগন্যাল ইন্সপেক্টর মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকেই ট্রেন চলাচলে 'এভনরমাল টাইমিংয়ে পাস' করছেন তারা। একটি লাইনে দুই দিকের ট্রেন চলাচলে এই শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন থেকে আপলাইনে ময়মনসিংহগামী বলাকা এবং ঢাকাগামী বুড়িমারী এক্সপ্রেস ডাউন লাইনে ছেড়ে চলে গেছে বলে জানান তিনি।
স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ মিয়া জানান, এক লাইনে ট্রেন চলাচল করতে গিয়ে রেশনিং পদ্ধতিতে ট্রেন চালানো হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ধীর আশ্রম স্টেশন এবং জয়দেবপুর জংশনে ট্রেন অপেক্ষায় রেখে একটি একটি করে ট্রেন দুই দিকে চলতে দেওয়া হচ্ছে এতে করে কোনো ট্রেনেরই শিডিউল ঠিক থাকছে না।
হানিফ মিয়া আরও জানান, শুক্রবারের দুর্ঘটনায় টাঙ্গাইল কমিউটারের পাঁচটি বগি দুমড়েমুচড়ে যায়, দুটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ১০টি বগি লাইনচু্যত হয়। শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে উদ্ধারকাজ শুরু হলেও শনিবার দুপুর পর্যন্ত উদ্ধার কাজ শেষ হয়নি।
এর মধ্যে শনিবার ১১টা পর্যন্ত দুই ট্রেনের ইঞ্জিনসহ আটটি বগি উদ্ধার করা হয়েছে আর বাকি দু'টির উদ্ধার কাজ চলমান রয়েছে। এ কাজে আরও দুই-আড়াই ঘণ্টা সময় লাগতে পারে বলে জানান স্টেশন মাস্টার হানিফ।
দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি শনিবার কাজ শুরু করেছে। প্রথমে এ কমিটির প্রধান ও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনে আপ গুমটি স্টেশন মাস্টার আবুল হাসেম, পয়েন্টস ম্যান সাদ্দাম ও মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুলস্নাহ আল আরেফিন ও জয়দেবপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ মিয়া।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমান জানান, এ দিন সকালে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্তের বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরে দুপুরে জয়দেবপুর জংশনে ট্রেন দুর্ঘটনার দিন কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার আবুল হাসেম, পয়েন্টস ম্যান সাদ্দাম ও মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার ও তাদের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন।
তিনি আরও বলেন, পরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিকৃত দুর্ঘটনা কবলিত টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের যাত্রী শরীফ মাহমুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। কিন্তু সেখানে ভর্তিকৃত এএলএম সবুজ হাসান ও এল এম মো. হাবিবুর রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর হওয়ায় তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে রংপুরের উদ্দেশে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ার সময় ছিল সকাল ৯টা ১০ মিনিট। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি দেরিতে বেলা আড়াইটাতেও ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছাতে পারেনি।
ঢাকা থেকে জামালপুরের তারাকান্দি গন্তব্যের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেনের কমলাপুর থেকে ছাড়ার কথা ছিল বেলা সাড়ে ১১টায়। দুই ঘণ্টা দেরিতে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনের চার নম্বর পস্ন্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল।
পরে বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে ট্রেনটি কমলাপুর ছেড়ে যায়। ট্রেনের এমন শিডিউল বিপর্যয়ে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে কমলাপুর স্টেশনে আসা যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন।
শনিবার বেলা ১টার দিকে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের ভিড় জমেছে। স্টেশনের ভেতরে ও পস্ন্যাটফর্মে যাত্রীদের যেখানে বসার জায়গা আছে, সেখানে কোনো আসন খালি নেই।
সন্তান ও স্বজন নিয়ে কেউ বসে আছেন, কেউবা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছেন বসার জায়গা না পেয়ে। স্টেশনের ভেতর অনেক যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
বগুড়ার সান্তাহার যেতে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কেটেছিলেন খায়রুল আলম। সকাল ৯টায় ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। স্ত্রী মেঘনা আলম ও মেয়ে সারিহা তাসনিমকে নিয়ে সকাল ৮টার মধ্যেই কমলাপুর স্টেশনে চলে আসেন বলে জানান তিনি।
খায়রুল আলম বলেন, 'ট্রেনটি কোথায় আছে, আসতে কতক্ষণ লাগবে, কিছুই জানতে পারছি না। একবার এলইডি বোর্ডে দেখাল ট্রেন ১২টা ৪০ মিনিটে ছাড়বে। আবার এখন দেখাচ্ছে ১টা ২০ মিনিটে ছাড়বে। ট্রেন আদৌ আসবে কিনা, সেটাই এখন নিশ্চিত হওয়া দরকার।' বেলা ১টার দিকে খায়রুলের স্ত্রী মেঘনা আলম বলেন, 'এই গরমে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে, খারাপ লাগছে। মেয়েটা বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।'
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল থেকেই ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। কমলাপুর স্টেশনে বেলা পৌনে ২টার দিকে ১ নম্বর পস্ন্যাটফর্মে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেনটি ছাড়ার কথা ছিল বেলা সোয়া ১টায়। কখন ছাড়বে, সেই সময় স্টেশনের এলইডি বোর্ডে দেখা যায়নি।