শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি!

লাশ তোলার অনুমতি চাইবেন গোয়েন্দারা

মিল্টনকে জিজ্ঞাসাবাদ সত্যতা মিলেছে ভুয়া মৃতু্য সনদ তৈরির
গাফফার খান চৌধুরী
  ০৪ মে ২০২৪, ০০:০০
মিল্টন সমাদ্দার

মিল্টন সমাদ্দারের 'চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টারে' নিহত ব্যক্তিদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে কবর থেকে লাশ তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এজন্য আদালতের কাছে অনুমতি চাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সম্প্রতি কবর দেওয়া লাশের পোস্টমর্টেম করলেই অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মনে করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

ডিবি সূত্রে জানা গেছে, আশ্রমে নিহতদের জাল মৃতু্য সনদ তৈরির অভিযোগে মিল্টন সমাদ্দারকে তিন দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। জাল সনদ তৈরির সূত্র ধরেই আসামির বিরুদ্ধে নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে রীতিমতো সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মিল্টন সমাদ্দার যেহেতু তার আশ্রমে নিহতদের জাল মৃতু্য সনদ তৈরি করেছেন, সেক্ষেত্রে নিহতদের মৃতু্য স্বাভাবিক নয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু মৃতু্য স্বাভাবিক নয়, তাই সন্দেহ রীতিমতো গভীর হয়েছে। মিল্টনের আশ্রমে মৃতু্য হওয়া ব্যক্তিদের ঘিরে গভীর রহস্য থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির অভিযোগ ও সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে তার আশ্রমে নিহত ব্যক্তিদের ভুয়া মৃতু্য সনদ তৈরি করার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। যেহেতু আসামি ভুয়া মৃতু্য সনদ তৈরি করতেন, তাহলে স্বাভাবিক কারণেই সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ মৃতু্য স্বাভাবিক হলে মিল্টন সমাদ্দারের ভুয়া মৃতু্য সনদ তৈরি করার প্রয়োজন ছিল না। যেকোনো সরকারি বা অনুমোদিত হাসপাতালে লাশ পাঠিয়ে মৃতু্য সনদ নিতে পারতেন। কিন্তু সেটি তিনি করেননি। মূলত সেটিই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এমন ঘটনায় স্বাভাবিক কারণেই নিহতদের শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এমনকি গভীর সন্দেহেরও সৃষ্টি করেছে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে নিহতদের শরীর থেকে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির অভিযোগ ওঠেছে, তাই অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে প্রয়োজনে মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে নিহতদের যেখানে কবর দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে লাশ তোলা হবে। সবশেষ মিল্টন সমাদ্দার কতজনের লাশ কোন কোন কবরস্থানে দাফন করেছেন, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে সবশেষ দাফন করা এক বা একাধিক লাশ কবর থেকে তুলে পোস্টমর্টেম করে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হবে। এজন্য যাবতীয় প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া মিল্টন সমাদ্দারের নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও বিস্তারিত জানতে প্রয়োজনীয় আলামত ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ অব্যাহত আছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরপুর মডেল থানাধীন দক্ষিণ পাইকপাড়ার ৮ নম্বর সড়কের ৪৬২ নম্বর দু'তলা বাড়িতে মিল্টন সমাদ্দারের 'চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার' সেন্টারের অবস্থান। সেখান থেকে দক্ষিণ পাইকপাড়ার ৪২৯ নম্বর পাঁচতলা বায়তুস সালাম মসজিদের দূরত্ব মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণ দিকে।

এ ব্যাপারে কথা হয় মসজিদটির খাদেমসহ অনেকের সঙ্গেই। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মিল্টন সমাদ্দার যতগুলো লাশ গোসলের জন্য পাঠিয়েছেন, প্রত্যেকটি লাশের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা ছেড়ার দাগ ছিল। এমনকি প্রত্যেক লাশেরই একই জায়গায় কাটাছেড়া চিহ্ন দেখা গেছে। বিশেষ করে কোমরের দিকে। ওইসব জায়গা কেটে মানুষের কিডনি বের করা হয় বলে শোনা যায়। এমন কাটা ছেড়ার কারণে তাদের সন্দেহ হয়। তারা লাশের গোসল করানো ও জানাজা নামাজ পড়ানো থেকে বিরত থাকেন। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে পুরো এলাকায় গুঞ্জন শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায়ই মিল্টন সমাদ্দারের কর্মকান্ড নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

মসজিদসংলগ্ন একটি বাড়ির বাসিন্দা রুবেল জানান, তার বৃদ্ধ শ্বশুর ও শাশুড়ি একটি ইনজেকশন নিয়ে সম্প্রতি আশ্রমটির একজন নার্সের কাছে গিয়েছিলেন। নার্সকে তার শ্বশুর বলেন, ইনজেকশনটি তার শরীরে পুশ করে দিতে। তারা কেন আশ্রমে ঢুকেছেন এমন কথার সূত্রধরে তাদের বেধড়ক মারধর করে মিল্টন সমাদ্দারের লোকজন। ঘটনার প্রতিবাদ করায় জামাই রুবেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিল্টন সমাদ্দার মিথ্যা মামলা করে তাদের হয়রানি করান।

রুবেল আরও বলেন, অনেক আগে মিল্টন সমাদ্দার একজন বৃদ্ধাকে নিয়ে ফেসবুক লাইফ করেন। সেই দিয়ে তার শুরু। তখন তিনি দক্ষিণ পাইকপাড়ার ঝিলপাড় বটগাছ তলা এলাকায় একটি টিনশেড ঘরে থাকতেন। এরপর তিনি আরও একটি টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে মানবিক কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথম প্রথম সবাই তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করত। ২০১৪ সালে তিনি দু'তলা বাড়িটি ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। বাড়িটির মালিক ইকবাল হোসেন।

স্থানীয়রা জানান, পাইকপাড়া এলাকার অনেক বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী মিল্টন সমাদ্দারকে নানাভাবে সহায়তা করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মসজিদের খাদেমরা মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে নিহতদের গোসল করাতে গিয়ে লাশের বিভিন্ন জায়গায় কাটা ছেড়া দেখতে পান। এর পরই শুরু হয় নানা গুঞ্জন। এরপর এলাকার লোকজন সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে দেন।

স্থানীয়রা আরও জানান, এমন পরিস্থিতিতে মিল্টন রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া শিশু কিশোর, বৃদ্ধা-বৃদ্ধাসহ নানা বয়সি মানুষদের নিয়ে আসতে থাকেন আশ্রমটিতে। তবে মিল্টন সমাদ্দার অবহেলিত ওইসব মানুষের যতটা না সেবা দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ওইসব অসহায় মানুষ নিয়ে ব্যবসা করেছেন। তাদের দেখিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ করেছেন। কনটেন্ট তৈরি করে ছেড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। আসলে একজন অসহায় মানুষকে সবার আগে পাওয়ার পর তার সেবা দেওয়া জরুরি। কিন্তু মিল্টন সেটি না করে প্রথমেই ওইসব অসহায় মানুষকে দিয়ে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করতেন। তাদের চিকিৎসাসহ ব্যয়ভার মেটানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহায়তা চাইতেন। আর তাতেই বাজিমাত। লাখ লাখ টাকা জমা হতো তার অ্যাকাউন্টে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মিল্টন সমাদ্দারের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। তারা কোনো সময়ই আশ্রমের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিত না। আশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করায় অন্তত ২০ জনকে মারধর করেছে মিল্টনের লোকজন, যা এলাকার মানুষ সবাই জানেন।

প্রসঙ্গত, গত ১ মে রাতে আশ্রম থেকে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা হয়। একটি মামলার বাদী পুলিশ। অপর দু'টি মামলার বাদী দুই ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার বিকালে তাকে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির মিরপুর জোনাল টিমের এসআই কামাল হোসেন। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেন শুনানি শেষে আসামিকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, আসামি তার আশ্রমে থাকাকালীন মৃতু্যবরণ করা ৫০ জন ব্যক্তির জাল মৃতু্য সনদ তৈরি করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে