দেশে ডলারের জোগান বাড়াতে 'অফশোর ব্যাংকিং' কার্যক্রম জোরদারের তাগিদ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত তাগাদা দিচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় আইনি ও রাজস্ব ছাড় দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। এদিকে, প্রবাসীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে এ খাতে ডলারের জোগান বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
জানা গেছে, পাঁচটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন এবং চীনা ইউয়ানে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম চলবে। তবে পাঁচটি মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ থাকলেও ডলার বেশি ব্যবহৃত হবে। কারণ ডলার সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। আর এতে রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ প্রেক্ষাপটে গত ২৮ এপ্রিল বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২২ এপ্রিল অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের অর্জিত মুনাফার (সুদ) ওপর কোনো কর দিতে হবে না মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়াও প্রস্তুত করে। খসড়া বিধানে স্টেকহোল্ডার হিসেবে এনবিআরের মতামত অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। খসড়া আইনের দফা ১৩(ক) অনুযায়ী অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট কর্তৃক অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না।
এর আগে ২৮ ফেব্রম্নয়ারি অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ। ডলার সংকটের বিষয়টি অনেক ভুগিয়েছে দেশের আমদানি বাণিজ্যকে। এক্ষেত্রে কাজে আসেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া কোনো উদ্যোগই, যার প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে, রিজার্ভ নেমেছে তলানিতে।
জানা গেছে, দেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল। পরে ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৮ ফেব্রম্নয়ারি অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। ফলে বিনিয়োগকারী অনাবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে।
পাঁচ ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনো প্রকার করই দিতে হবে না। সেইসঙ্গে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে তার ওপরও কোনো কর আরোপ করা হবে না। এমনকি অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনো সুদ বা চার্জ দিতে হবে না।
বর্তমানে অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের থেকে আমানত নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এ আইনটি পাস হলে তফসিলি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটগুলো বিদেশিদের পাশাপাশি অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের থেকেও আমানত নিতে পারবে।
অনুমোদিত নতুন আইনে কোনো ঋণসীমা রাখা হয়নি। এতে যেকোনো পরিমাণ লেনদেন করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিজেডে যে অফশোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে তা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে কোনো লাভ দেওয়া হয় না। তবে নতুন আইনে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে লাভ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
এই খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে। শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। যাদের লাইসেন্স আছে তাদের নতুন করে নিতে হবে না।
বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে তারা বিদেশি বা অনাবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে।
অনুমোদিত এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশি বা অনাবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে।
বিদেশে যে বাংলাদেশি বসবাস করছেন তার পক্ষে দেশে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তারা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন।
ব্যাংকাররা বলছেন, এই ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অসুবিধার চাইতে সুবিধাই বেশি। এই ব্যাংকিংয়ে যেকোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি দেশ-বিদেশে সহজ শর্তে ব্যবসা করতে পারবে।
অনুমোদিত নতুন আইনের আওতায় সরকার এই ব্যাংকিং কার্যক্রমে আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এতে বিধিনিষেধ একেবারেই কম। গ্রাহকের তথ্য সংক্রান্ত চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা হলো ব্যাংকের ভেতরে পৃথক ব্যাংকিং সেবা। অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে আমানত গ্রহণ ও ঋণ বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশি গ্রাহকদের দেওয়া হয়। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ এবং বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবসা হয় এ ব্যাংকিংয়ে।
তিনি আরও বলেন, 'এটা ভালো উদ্যোগ। বাংলাদেশি যারা বিদেশে আছেন তারা যেন তাদের ফরেন কারেন্সি বাংলাদেশে এনে রাখেন। ভারত বিগত ৫-৭ বছরে এটাতে খুব সফল হয়েছে। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ভালো করেছে। আমরা শুরু করছি। আমাদের এখন প্রয়োজন সব ব্যাংককে এটা ভালোমতো বুঝিয়ে এর প্রোডাক্ট তৈরি, মার্কেটিং এবং বিভিন্নভাবে এটাকে প্রমোশন করা। সেটা কীভাবে কী হবে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।'
মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছে, অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে লোন নিয়ে দেশে ব্যবসা করছে। দেশে লোন শোধ করছে। এক্ষেত্রে তার এক্সপোর্ট সেভাবে না থাকলে ওই লোন শোধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। তার মানে তাকে উল্টা করে লোকাল টাকা দিয়ে লোন শোধ করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত এক্সপোর্টের মাধ্যমে কাভার না করলে ওই লোন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে।
এ সমস্যা রোধে তদারকি করা প্রয়োজন উলেস্নখ করে তিনি বলেন, যে কারণে লোন দেওয়া হচ্ছে সেটা পালন হচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং জরুরি। এই কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন এই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে উলেস্নখ করে গণমাধ্যমকে বলেন, 'এটা এখন সর্বাধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা। পৃথিবীর বহু দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ও আর্থিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করেছে। এতে করে তারা শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। এছাড়া আমরা এটিকে একটি অপশন হিসেবে ব্যবহার করছি, যাতে বিদেশিরা এসে টাকা রাখতে পারে। তবে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে টাকা নিয়ে যাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয়। অফশোর এই আইনে স্বাধীনভাবে অপারেট করা যাবে।'
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরো জানান, 'বাংলাদেশে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ নিয়ে যান, তখন তারা বাইরের অফশোর কোনো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টাকা রাখেন। আবার আমাদের এখানে যখন আনেন তখন তারা আমাদের কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাংকে ঢোকান না। কারণ যখন তারা নিয়ে যাবেন তখন নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এখানে একটা সুবিধা হবে বিদেশিরা ব্যবসা করে যে লভ্যাংশ পাবেন সেটা এখন ব্যাংকে রাখবেন। কারণ এখন ব্যাংকে টাকা রাখলেই লাভ দেওয়া হচ্ছে। যেটা আন্তর্জাতিকমানের। সুতরাং এখানে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই এটি করা হচ্ছে।'
বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। অনাবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশ থেকে যখন দেশে থাকা অফশোর ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাবে তখন সেই মুদ্রাতেই লেনদেন করবে। এছাড়া এ ধরনের অ্যাকাউন্টধারীদের সরকার প্রচুর ট্যাক্স বেনিফিট দিয়ে থাকে।