শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস আজ

বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন দেশের গণমাধ্যম

বীরেন মুখার্জী
  ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন দেশের গণমাধ্যম

সাংবাদিকতার জন্য ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে ৯টি আইন রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। আরও তিনটি আইন চূড়ান্ত খসড়া পর্যায়ে। এর পাশাপাশি প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের বিষয়টি ধরলে এমন আইনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৩টি। সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য দেশে আজও কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি। দেশের গণমাধ্যম বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, 'গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো মনোভাব নেই, সরকার কমিটেড গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দিতে। গণমাধ্যম শুধু মুক্ত নয়, উন্মুক্ত।'

রেকর্ড বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে সাংবাদিক হত্যা এবং সাংবাদিকের ওপর হামলা বাংলাদেশে একটি গুরুতর বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশকে সাংবাদিকদের জন্য একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৩৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সাংবাদিক হত্যার বিচারেও তেমন অগ্রগতি নেই। কয়েকজন সাংবাদিক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে নামমাত্র তদন্ত হলেও অনেক হত্যার ঘটনা কয়েক দশক ধরে অমীমাংসিত। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যার রহস্য এখনো অনুদ্ঘাটিত। দেশে সাংবাদিকতার এমন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে বছর গড়িয়ে আবারও এসেছে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এই দিনে মুক্ত গণমাধ্যমের মৌলিক নীতিমালা পালনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করার অঙ্গীকার এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে জীবন উৎসর্গকারী সাংবাদিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে দিনটি পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হবে।

১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে'র (বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকরা দিবসটি পালন করে আসছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবাদিকতা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের মতে, সাংবাদিকতা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পেশাগুলোর মধ্যে একটি। কী ঘটছে, তা অনুসন্ধান করতে এবং প্রতিবেদন তৈরি করতে সাংবাদিকরা বিভিন্ন স্থানে যান। দুর্ভাগ্যবশত, এই পেশা নিজেই কখনো কখনো অপহরণ, হামলা, এমনকি হত্যার গল্প হয়ে ওঠে।

চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬৩তম অবস্থানে উঠে আসে। যদিও 'ভুল ও অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে' এই র?্যাংকিং করা হয়েছে, দাবি সরকারের। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'এর মাধ্যমে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ক্রমবিকাশ, সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য বর্তমান সরকারের অব্যাহত উদ্যোগকে অস্বীকার করা হয়েছে। দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার অবাধ স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্রের বিপরীতে আরএসএফের মূল্যায়ন অগ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতদুষ্ট এবং সত্যের বিচু্যতি বলে সরকার মনে করে।'

তখন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত সাংবাদিকদের বলেন, 'আরএসএফ এর দাবির বিপরীতে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সরকারি গণমাধ্যমের চেয়ে বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেল সম্প্রসারণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। 'সাইবার স্পেসকে সন্ত্রাসী, মৌলবাদী ও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে' ২০১৮ সালে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) কিছু ধারা নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ডিএসএ বাতিল করে এর পরিবর্তে ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার।'

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা ও নিপীড়ন চললেও বিচার পেতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। হত্যার দুই-একটি ঘটনায় ১২ বছরের বেশি সময় পর বিচারিক আদালতে বিচার মিললেও চূড়ান্ত বিচারের অনেক ক্ষেত্রেই সেটি দীর্ঘায়িত হয়।

২০১২ সালের বছর ১১ ফেব্রম্নয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন করা হয়। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ১২ বছরের বেশি সময় পার হলেও আলোচিত এই হত্যার বিচারের দাবিতে এখনো আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করেন সাংবাদিকরা। ইতোমধ্যে এই হত্যা মামলার প্রতিবেদন দিতে ১০৬ বারের মতো সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থার্ যাব।

এ ঘটনার আগে-পরেও সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। কিন্তু গত দুই দশকে বিচারে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে- এমন ঘটনার নজির নেই বলে জানান আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, 'দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দুই-একটি ছাড়া গত ৫০ বছরে দেশে কোনো সাংবাদিক হত্যার চূড়ান্ত বিচার হয়নি। এটির কারণ হতে পারে হয়ত এ বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আর যারা সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনে অভিযুক্ত, তারা সব সরকারের আমলেই প্রভাবশালী এবং সরকারি মদদপুষ্ট লোক। তারা ক্ষমতার শক্তিতে বলীয়ান হয়েই এসব করেন।'

২০০০ সালের ১৬ জুলাই রাতে যশোরে গুলি করে হত্যা করা হয় দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামছুর রহমানকে। দুইবার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর ২০০৫ সালের জুন মাসে অভিযোগ গঠন করা হয়। কিন্তু আসামিপক্ষ মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে আবেদন করে হাইকোর্টে। এই আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় এই মামলার বিচারকাজ প্রায় ২৩ বছর ধরে বন্ধ।

১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট খুন হন যশোরের দৈনিক রানার পত্রিকার সম্পাদক আর এম সাইফুল আলম মুকুল। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে ২২ জনকে অভিযুক্ত করে যশোরের সংশ্লিষ্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে মামলাটি স্থগিত হয়ে যায়।

২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে বোমা হামলায় নিহত হন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক মানিক সাহা। প্রায় ১৩ বছর পর বিচারিক আদালতে এই হত্যা মামলার রায় আসে। মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। বিস্ফোরক মামলা এখনো বিচারাধীন।

২০০৪ সালের ২৭ জুন খুলনার শান্তিধাম এলাকায় সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক 'জন্মভূমি' পত্রিকার সম্পাদক ও খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবির বালু। ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি হত্যা মামলার রায়ে সাত আসামি খালাস পেয়ে যান। আর বিস্ফোরক মামলায় ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি পাঁচজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেয় খুলনার বিচারিক আদালত। হত্যা মামলায় খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে বালুর পরিবারের করা আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানান।

২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর দৈনিক সমকালের ফরিদপুর বু্যরো প্রধান গৌতম দাস হত্যা মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রম্নয়ারি সিরাজগঞ্জে শাহজাদপুর এলাকায় সংঘর্ষের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনরত একই পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল শটগানের গুলিতে নিহত হন। এই মামলার বিচারকাজ এখনো শুরু হয়নি।

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলেন, মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মাধ্যমে নাগরিকরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথ্য জানার পাশাপাশি তাদের নেতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য জানাতে পারেন। স্বাধীন গণমাধ্যমের অধিকারের বিষয়টি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার দলিলের পাশাপাশি বাংলাদেশসহ অনেক দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত।

তারা বলেন, মুক্ত গণমাধ্যম মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যও অত্যাবশ্যক। সাংবাদিকরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো প্রকাশ ও জবাবদিহি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়, 'প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে; কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়া অবাধে মতামত পোষণ করা এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোনো মাধ্যমের মারফতে তথ্য ও ধারণাগুলো জানা বা অনুসন্ধান, গ্রহণ ও বিতরণ করা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।'

এদিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস সামনে রেখে বৃহস্পতিবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, 'দেশের গণমাধ্যম বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কাজের সুযোগ সংকুচিত করা হচ্ছে। আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার রাজনীতিকরণ হওয়ায় দুর্বল হয়েছে জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।'

পর্যবেক্ষকদের মতে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার মূল্যবোধকে সম্মিলিতভাবে সমুন্নত রাখেন সাংবাদিকরা। ফলে সাংবাদিকদের অবশ্যই হয়রানি, ভীতি বা সহিংসতার ভয় ছাড়াই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে