বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

নিরাপদ ট্রেন যাতায়াতে বিপদ বাড়াচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ লাইন

বসন্তেও বেঁকে যাচ্ছে রেলপথ হ কাঠের তৈরি পুরনো লাইনগুলোতে পচে গেছে স্স্নিপার বেশিরভাগ লাইনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ অভিযোগ উঠেছে তদারকি না থাকা ও অবহেলার
যাযাদি ডেস্ক
  ০১ মে ২০২৪, ০০:০০
নিরাপদ ট্রেন যাতায়াতে বিপদ বাড়াচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ লাইন

রেলওয়ের পাতের স্বাভাবিক তাপমাত্রা গ্রহণের সক্ষমতা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর চেয়ে ৫ থেকে ১০ ডিগ্রি বেশি হলে লাইনের পাত বেঁকে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির চেয়ে কম থাকার পরও মাঝেমধ্যে বেঁকে যাচ্ছে রেলপথ। এমনকি গরম আসার আগে বসন্তকালেই এ ঘটনা ঘটেছে। পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন- তুলনামূলক 'নিরাপদ বাহন' হিসেবে রেল অনেক জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও নানা কারণেই তা এখন বিপদ হয়ে উঠেছে। তাদের মতে- মেয়াদোত্তীর্ণ লাইন, তদারকি না থাকা ও অবহেলার কারণেই রেলপথ বেঁকে যাচ্ছে, বাড়াচ্ছে ঝুঁকি। ঘটছে বড় বড় দুর্ঘটনা।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক রেললাইনের স্স্নিপারে নাট-বল্টু নেই, আবার কোথাও ক্লিপ নেই কিংবা ক্লিপের পরিবর্তে সুতো পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে নাট খুলে না পড়ে। কিছু জায়গায় চুরি হয়ে গেছে ফিশপেস্নট। অন্যদিকে কাঠের তৈরি পুরনো লাইনগুলোতে পচে গেছে স্স্নিপার। ফলে পুরো রেললাইন হয়ে গেছে নড়বড়ে। এ সমস্যা সারাদেশেই আছে। বছরের অন্য সময় জোড়াতালি দিয়ে রেললাইনগুলো চালানো গেলেও এপ্রিল থেকে জুনে মাসে বাঁধে বিপত্তি। এ সময় তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা।

অতিরিক্ত তাপে সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুরে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ঢাকা-নরসিংদী রুটে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার আড়িখোলা এলাকায় রেললাইন বেঁকে গেছে। মঙ্গলবার দুপুরে আড়িখোলা এলাকায় একটি স্থানে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন স্টেশন মাস্টার রুবেল মিয়া।

টঙ্গী রেলস্টেশনের রেল পুলিশের ইনচার্জ ছোটন শর্মা আড়িখোলা স্টেশন মাস্টার রুবেল মিয়ার বরাত দিয়ে বলেন, 'অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কালীগঞ্জ উপজেলার আড়িখোলা এলাকায়

একটি স্থানে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে সেখানে ডাবল লাইন থাকায় অন্য একটি লাইন দিয়ে রেল চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। দুপুর দেড়টার দিকে রেললাইন মেরামতের কাজ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ওই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।'

এর আগে গত শুক্রবার পাবনার ঈশ্বরদীতে বাইপাস রেলওয়ে স্টেশনে রেললাইনের পাত বেঁকে গিয়ে একটুর জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় খুলনা থেকে রাজশাহীগামী আন্তঃনগর ট্রেন কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস। পরে দুই ঘণ্টা ধরে রেললাইনের ওপর পানি ঢেলে বেঁকে যাওয়া পাত স্বাভাবিক করা হয়। সেদিন ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এর আগে চলতি বছরের ৪ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আজমপুর স্টেশনের কাছে অন্তত ১৫ ফুট রেললাইন বেঁকে যায়। যদিও তখন দাবদাহ ছিল না। তখন বসন্ত ঋতু ছিল।

এ ছাড়া গত বছরও এ সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে পরপর দুই দিন পাত বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন ও পুরনো লাইনের মধ্য একটা পার্থক্য থাকে। নতুন-পুরনো লাইনের কথা মাথায় রেখেই নিরাপত্তা বিবেচনায় গতি কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।'

রেললাইন নতুন হলে ঝুঁকি কম থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, 'লাইন পুরনো হলে গতি যা থাকে তার থেকে অর্ধেক করে দেওয়া হয়।'

রেল সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে এখন রেলপথ আছে তিন হাজার ৯৩ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে চার হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। রেল মন্ত্রণালয়ের ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। সে হিসেবে বাকি রেলপথ পুরনো। পুরনো রেলপথের বড় অংশের রেললাইন ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা।

বর্তমানে দেশের রেলপথ দুই অঞ্চলে বিভক্ত- পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। দুই অঞ্চল মিলে এক হাজার কিলোমিটার রেললাইন অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ বলে জানা গেছে। কিছু কিছু রেললাইন আছে যেটি ৩০ বছরেও সংস্কার হয়নি। বেশিরভাগ লাইনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। আবার কোনটির শেষ হওয়ার পথে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক বলেন, ১৯৭৩ সালে রাজশাহী থেকে আব্দুলপুর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়। একটি রেললাইনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। কিন্তু এই স্স্নিপার ও রেললাইনের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটি করে জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ লাইনে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, স্স্নিপারের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়া, ফিশপেস্নট ও নাট-বল্টু না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের রেললাইনগুলো।

রেলের ২০২৩ সালের সমীক্ষা মতে, পূর্বাঞ্চলের ১৬ জেলায় লাইনের সমস্যা বেশি। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিলস্না, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও ঢাকায় রেলপথে এসব সমস্যা রয়েছে।

অন্যদিকে রেলের পশ্চিমাঞ্চলে জেলা বিবেচনায় রাজশাহী, ঢাকা, রংপুর ও খুলনা বিভাগের ২৩ জেলায় সমস্যা বেশি রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা-চিলাহাটি-পঞ্চগড় ও রাজবাড়ী-ঢাকা রুটের রেললাইনে কংক্রিট স্স্নিপার আছে।

দেশের ৭০ শতাংশ রেললাইন মেয়াদোত্তীর্ণ মন্তব্য করে পরিবহণ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে ২৫০০ কিলোমিটার রেলপথ মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ। তদারকি না থাকা ও অবহেলায় রেললাইনে ট্রেন লাইনচু্যত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে