দেশের বিভিন্ন স্থানে গরমের তারতম্য হয় যেসব কারণে

প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশ গত ১ এপ্রিল থেকে ২৭ দিন ধরে তাপপ্রবাহের দীর্ঘতম সময় প্রত্যক্ষ করছে এবং আবহাওয়া অফিস সতর্ক করেছে যে, এ অবস্থা পরবর্তী মাসজুড়ে অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বর্তমানে দেশের ২৫টি জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে অতি তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত আছে। বাকিগুলোর ওপর নেই। এখন প্রশ্ন হলো, অঞ্চলভেদে বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রার এই তারতম্য কেন? সূত্র : বিবিসি বাংলা বাংলাদেশের উষ্ণতম জেলা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওপর দিয়ে বর্তমানে মাঝারি থেকে অতি তীব্র মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক চার ডিগ্রিতে উঠলেও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। শনিবার চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এপ্রিলের প্রায় পুরোটাজুড়েই চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজশাহীও এই তালিকায় রয়েছে। মূলত, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বছরের এই সময় চুয়াডাঙ্গাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বরাবরই অসহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্থানেই মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যের কিরণ বা রশ্মি লম্বালম্বিভাবে এসে পড়ে। অল্প কিছু এলাকায় বাঁকাভাবে পড়ে। আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মলিস্নক বলেন, 'বিশেষ করে এপ্রিলে সূর্য বাংলাদেশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। এ সময় আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। আরও সহজ করে বলতে গেলে, এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশি পরে এই অঞ্চলে।' চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া এবং উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ এলাকার বাতাস উত্তপ্ত থাকার আরেকটি কারণ হলো 'লু হাওয়া'। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের দিলিস্ন, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এ সময় ওখানের তাপমাত্রা ৪২-৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। চুয়াডাঙ্গাসহ ওইসব জেলা দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর ভারত থেকে যে গরম বাতাস বা লু হাওয়া প্রবেশ করে, তা বাংলাদেশের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় বলে জানান আবহাওয়াবিদ মলিস্নক। বরিশালে বেশি গরম অনুভূত হয় কেন? আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার খুলনা বা রাজশাহী বিভাগের সবগুলো জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। সেখানকার কোনো জেলায় ৩৯ ডিগ্রির কমে কোনো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নেই। কিন্তু বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, ওইসব অঞ্চলের চেয়ে তাপমাত্রা অনেকটাই কম। কিন্তু বরিশালের তাপমাত্রা যশোর চুয়াডাঙ্গার চেয়ে একটু কম হলেও গরমের অনুভূতি খুবই বেশি বলে উলেস্নখ করেছেন আবহাওয়াবিদ ড. মলিস্নক। তিনি আরও বলেন, 'উপকূলীয় এলাকায় তাপমাত্রা এমনিতেও ৩৬-৩৮ ডিগ্রির বেশি ওঠে না। কিন্তু তাপমাত্রা কম থাকলেও গরমে সেখানে নাভিশ্বাস উঠে যায়।' কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন, বরিশাল অঞ্চলে প্রচুর নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর থাকার কারণে অনবরত বাষ্পায়ন হয়। এ ছাড়া, বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় ওখানের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি। মূলত, বাতাসে যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, তখন গরমও বেশি অনুভূত হয়। কিছু এলাকায় তাপমাত্রা সহনীয় এদিকে, আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশের তিনটি বিভাগ তাপপ্রবাহের বাইরে; রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট। সেখানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। যদিও শুক্রবার রংপুর বিভাগেরও বেশিরভাগ জেলার ওপর মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছিল। মূলত, যখন কোনো স্থানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকে, তখন সেই স্থানে মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই হিসাবে, ওই তিন বিভাগের অনেক স্থানে কোনো তাপপ্রবাহ বইছে না। বরং সহনীয় মাত্রার গরম পড়ছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলাও তাপপ্রবাহের বাইরে বলে জানিয়েছেন তিনি। ওই তিন বিভাগের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হওয়ার কারণও এগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান। এসব অঞ্চলে একদিকে যেমন আছে বিস্তীর্ণ হাওড়, অপরদিকে আছে সুউচ্চ পাহাড়। ড. মলিস্নক বলেন, 'ময়মনসিংহ এলাকায় হাওড়ের মতো বিশাল জলাধার আছে। এ ছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় ওখানে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়। তাই তাপমাত্রা কম। চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় গরম কম অনুভূত হওয়ার এটা প্রধান কারণ। আর যদি বনাঞ্চলের হিসাব করি, ওইসব অঞ্চলে বনায়ন বেশি এবং আশপাশে জলাধার আছে। বঙ্গোপসাগর থেকে যে জলীয় বাষ্প বাংলাদেশে প্রবেশ করে, সেটা পাহাড়ি এলাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন ওই জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাসের ঊর্ধ্বগমন ঘটে বা ওপরের দিকে যায়। এরপর, ওই বাতাসের ভেতর যে পানির কণা থাকে, তা ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। মেঘ তৈরির পর তা পাহাড়ের সম্মুখভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায় ও তাপমাত্রা কমায়।' এছাড়া, পাহাড়ি অঞ্চলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, 'পাহাড়ের একদিকে সূর্যের আলো পড়লে অন্যদিকে ছায়া পড়ে। আর, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বাতাস প্রবাহিত হয়। দুই পাশের, মানে উত্তপ্ত বাতাস ও ঠান্ডা বাতাস মিশ্রিত হয়ে সেখানকার তাপমাত্রা একটু কম রাখে।' গরম কমবে কবে? আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মলিস্নক জানান, চলতি মাসে গরম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে পহেলা মে থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকার কিছু এলাকার তাপমাত্রা কমবে। খুলনা, রাজশাহী, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার তাপমাত্রা কমলেও তাপপ্রবাহ চলমান থাকবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রঝড় ও কালবৈশাখী ঝড় হবে। তখন দুই থেকে ছয় ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমবে। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ 'আরামদায়ক' গেলেও তা স্থায়ী হবে না বলে জানান ড. মলিস্নক। কারণ, ১৯৭২ সালের মে মাসেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছিল। এ ছাড়া, প্রায় প্রতিবছরই মে মাসে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। তিনি বলেন, 'কখনো কখনো মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহ ও অতি তীব্র তাপপ্রবাহেরও রেকর্ড রয়েছে। সুতরাং, জলবায়ু অনুযায়ী, মে মাসেও তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছি। তবে বর্ষা-পূর্ববর্তী, এমনকি বর্ষাকালেও তাপপ্রবাহ দেখা দিতে পারে। ' তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশের তাপমাত্রায় এটি এখন দেখা যাচ্ছে যে, তাপপ্রবাহ শুধু মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে না; মনসুন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। গতবারও জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তাপপ্রবাহ ছিল।' উলেস্নখ্য, তিনি আরও জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে বর্তমানে টানা ২৭ দিন তাপপ্রবাহ বইছে। 'বাংলাদেশের ইতিহাসে এপ্রিল একক মাস হিসেবে এ রকম দীর্ঘমেয়াদে তাপপ্রবাহ ছিল না।' আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা বলেন। যদিও চলমান তাপপ্রবাহকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিলস্নুর রহমান। তার মতে, 'তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া স্বাভাবিক, এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ সময় এটা কম-বেশি প্রতিবছরই হয়। তবে এ বছর বেশি হচ্ছে। এর জন্য জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। ১৮৫০-১৯০০ সালের তাপমাত্রার সঙ্গে এখনকার তাপমাত্রা তুলনা করলে দেখা যায়, গড়ে পৃথিবির এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। এক ডিগ্রি বাড়াতেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাপদাহ, বন্যা, তুষারপাত দেখা যাচ্ছে।'