জাতীয় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে এক ধরনের কৌশলী অবস্থান নিয়েছিল। তৃণমূলের চাওয়া বিবেচনা করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষেই ছিলেন দলটির অধিকাংশ নেতা। কিন্তু পরবর্তীতে দুই কারণে শুধু নির্বাচন বর্জনই নয় কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। বিএনপি সূত্রমতে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া নিয়ে বিএনপিতে এখনো দুই ধরনের মত আছে। এই নির্বাচনে অনানুষ্ঠানিক অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন দলের অধিকাংশ নেতা। তবে প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছে। প্রভাবশালী এই নেতাদের দাবি, ভোটে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই এবং নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- এই দুটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত করতে বিএনপির ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তই সঠিক। এজন্য দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে কৌশলে ভোটে যাওয়ার পক্ষে থাকা নেতারা মনে করেন, নির্বাচন বর্জনের পরে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দলের ক্ষোভ বাড়বে। আর যে দুটি উদ্দেশ্যে ভোট বর্জন তা ব্যাহত হবে। কারণ আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করা যে সম্ভব হচ্ছে না তা সবার সামনে চলে এসেছে। উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ৭৬ নেতা বহিষ্কারের পরেও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের মাঠ থেকে অনেককেই সরানো যাবে না- এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। এরপরেও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর থাকবে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিএনপি তৃণমূলকে বার্তা দিতে চাইছে, বাকি ধাপের নির্বাচনে দলীয় কেউ অংশ নিলে একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপি সূত্রমতে, উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহ দমনে বিএনপি বলতে গেলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এজন্য সাংগঠনিক অন্য কর্মকান্ডে একরকম স্থবিরতা চলছে। কৌশলে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে থাকা নেতারা দলের কর্মকান্ডে অংশ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আন্দোলনের কর্মসূচি সফলে ভূমিকা রাখতেন এমন নেতারা নানা অজুহাতে সক্রিয়ভাবে সাংগঠনিক কাজে অংশ নিচ্ছেন না। এর অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঢাকা শোডাউন করার সিদ্ধান্ত নিয়েও গরমের অজুহাতে তা বাতিল করা হয়েছে। এর বাইরে সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও চলছে না বললেই চলে। এদিকে, সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনের পর সারাদেশে দলের সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট দিতে হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বেশ আগেই সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্বাচনের পর রাজপথের বিগত আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না আসার একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন করে বিএনপি। সে অনুযায়ী, অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ এবং বিগত আন্দোলনে রাজপথে ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে না পারা জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ধরনের ২০-২৫টির মতো জেলা কমিটি পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্তও হয়। এই প্রক্রিয়াও প্রায় থমকে গেছে। অন্যদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনের ভোটও বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে গত ১৫ এপ্রিল দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া দলীয় নেতাদের তা প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্র থেকে জানানো হয়। একইসঙ্গে তাদের সঙ্গে কথা বলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলার নেতারাও। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে শেষ পর্যন্ত ৩০ জনের মতো নেতা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন, যারা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন। পরে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে থাকা নেতাদের ৪৮ ঘণ্টার সময় দিয়ে শোকজ করে দলটি। এরপর তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। গত শুক্রবার ৭৩ নেতা বহিষ্কার করা হয়। শনিবার বহিষ্কার করা হয় আরও তিনজনকে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। এক নেতার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার এদিকে, ভুল স্বীকার করে উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরিপ্রেক্ষিত এক নেতার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করেছে বিএনপি। রোববার দলের সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত (উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেওয়া) অগ্রাহ্য করে প্রার্থী হওয়ায় দুইদিনে ৭৬ জনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। মেহেরপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সদস্য রোমানা আহমেদ আসন্ন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভাইস চেয়ার?ম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন। গত ২৬ এপ্রিল বিএনপির পক্ষ থেকে ৭৩ জনের বহিষ্কারের তালিকায় তার নাম ছিল। বহিষ্কারের চিঠি পাওয়ার পরে রোমানা স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেন। বিএনপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোমানা আহমেদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। নির্বাচনের ভাবনা বাদ জামায়াতের এদিকে, শুরু থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল জামায়াতের। এখন রহস্যজনক কারণে এই নির্বাচনের ভাবনা একেবারেই বাদ দিয়েছে দলটি। জামায়াত সূত্রগুলোর দাবি, উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে শুরু থেকে নমনীয় ছিল তারা। আগ্রহী নেতাকর্মীদের বাধা না দেওয়ার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তুতিতে সহযোগিতাও করছে দলটি। জয়ের সম্ভাবনা আছে, এমন উপজেলাগুলোয় নির্বাচন করার ব্যাপারে দলের মাঠপর্যায়ে বার্তা ছিল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও জেলা কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মার্চের শেষের দিকে জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হবে না- এমন সিদ্ধান্ত ছিল দলটির। মূলত জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান জামিনে মুক্তির পর এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত এবং জামায়াতের আমিরের মুক্ত হওয়ার মধ্যে সংশ্লিষ্টতা আছে বলে তখন অনেকে বলাবলিও করে। জামায়াতের একটি অংশের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু এখন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর কোনো প্রার্থী নেই। মধ্য এপ্রিলে দল আনুষ্ঠানিক এই সিদ্ধান্ত নেয়। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের পর দলটির প্রথম ধাপের সব প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আর আগামী ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও দলটির কেউ মনোনয়নপত্র নেননি- এমন দাবি জামায়াত সূত্রগুলোর। একদিকে বিএনপি বিদ্রোহ দমনে হিমশিম খাচ্ছে অন্যদিকে জামায়াত নির্বাচনী ভাবনা পুরোপরি বাদ দিয়ে সংগঠন শক্তিশালী করার কাজে নেমে পড়েছে। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে মহানগর, থানা ও উপজেলা পর্যায়ে রুকন (সদস্য) সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। গত তিন মাসে সম্মেলন হয়েছে ৩০টিরও বেশি সাংগঠনিক জেলায়। এ ছাড়া নবাগত ও অগ্রসর কর্মীদের জন্য কয়েকটি শিক্ষা শিবির, সহযোগী সদস্যদের সভা ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা এবং নির্বাহী পরিষদের একাধিক সভা ও বিশেষ রুকন সম্মেলনও হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। এখন সারাদেশে সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা হচ্ছে।