ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

'অবৈধ' ধুয়া তুলে বছরে সাত হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি

প্রকাশ | ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের অলিগলি থেকে রাজপথে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করছে। পরিবেশবান্ধব এ যান চলাচলে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিচ্ছে। অথচ 'আইনগত অবৈধ' এ অভিযোগ তুলে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার মালিক-চালকদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। যার পুরোটাই ট্রাফিক ও থানা পুলিশের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে ঢুকছে। অন্যদিকে আইনগত বৈধতা না থাকায় দেশের কোথাও এ ধরনের যানবাহনের কোনো বৈধ চার্জিং স্টেশন গড়ে ওঠেনি। এ সুযোগ বিদু্যৎ বিভাগের ধান্দাবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিভিন্ন রিকশার গ্যারেজে চোরাই লাইনের মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা চার্জ দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রতিদিন প্রায় ৮শ' মেগাওয়াট বিদু্যৎ চুরি হচ্ছে। এ হিসাবে মাসে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং বছরে ২ লাখ ৮৮ হাজার মেগাওয়াট বা ২৮ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট বিদু্যতের বিলের টাকা বিদু্যৎ বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, স্থানীয় লাইনম্যান ও প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে ভাগাভাগি হচ্ছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত যানবাহন, বাইসাইকেল, রিকশা ও রিকশাভ্যানকে মোটর যানের স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে সরকার। চলতি বছরের ১৩ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক পরিবহণ সংশোধন আইন ২০২৪-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। সেখানে ব্যাটারিচালিত যানবাহনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের এই তথ্য নিশ্চিত করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংশোধনীর খসড়ায় তিন চাকার মোটর যানের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রস্তাব করা হয়েছে 'পঞ্চম শ্রেণি পাস'। যন্ত্রচালিত বা বৈদু্যতিক ব্যাটারিচালিত যানবাহন, বাইসাইকেল, রিকশা ও রিকশাভ্যানকে মোটর যানের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিমার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে সংশোধনীতে। হাইকোর্ট ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার অটোরিকশা বন্ধের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি এ ধরনের গাড়ি নির্মাণ আমদানি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধের নির্দেশও রয়েছে হাইকোর্টের আদেশে। কিন্তু এরপরও রাজধানীসহ সারা দেশের অলিগলিতে অবাধেই এ ধরনের যান চলাচল করছে। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা নিয়ে সরকার শুরু থেকেই দ্বিমুখী আচরণ করছে। ইজিবাইকের পার্টস আমদানি ও বিক্রি বৈধ হলেও এ যান চলাচল অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া শুরুর দিকে বিদু্যতচালিত ইজিবাইক আমদানি হলেও এখন গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে এযান প্রকাশ্যে উৎপাদিত হচ্ছে। সারাদেশে তা বিক্রির হাজার হাজার শো-রুম গড়ে উঠেছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা চলাচলে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ধীর সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে পুলিশ ও বিদু্যৎ বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর নেপথ্যে সরকারের প্রভাবশালীদেরও পরোক্ষ মদদ রয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব চলছে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অধীনে। এদের নিয়ন্ত্রক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা। এক-একটি থানা শুধু ব্যাটারিচালিত রিকশার সিন্ডিকেটের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে থাকে। এসব রিকশা চিহ্নিত করা হয় টোকেনের মাধ্যমে। আর এ টোকেন নিতে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা-ভ্যান মালিককে দিতে হয় ১৫শ' থেকে ১৮শ' টাকা। যার একটি অংশ যায় থানায়। ফলে কোনো বাধা ছাড়াই রাস্তায় চলতে পারে এসব অবৈধ যান। রাজধানীর পুরান ঢাকা, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, মাদারটেক, নন্দীপাড়া, সবুজবাগ, বাসাবো, মুগদা, কদমতলা, বৌদ্ধমন্দির, বনশ্রী, মিরপুর, পলস্নবী, কালসী এলাকায় এ চাঁদাবাজি সবচেয়ে বেশি। সেখানে এসব অবৈধ যান চালকদের প্রতি মাসে নূ্যনতম দুই হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। রাজধানীর নন্দীপাড়ার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক জয়নাল জানান, প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা তাকে দিতে হয় স্থানীয় নেতাদের লোকজনকে। বিনিময়ে রিকশায় লাগিয়ে দেওয়া হয় একটি স্টিকার। এ স্টিকারের মেয়াদ এক মাস। এ স্টিকার থাকলে পুলিশ তাদের কিছু বলে না। না থাকলে গাড়ি আটকে ডাম্পিং করা হয়। সেখান থেকে রিকশা ছাড়িয়ে আনতে তিন-চার হাজার টাকা লাগে। তাই এ ঝুঁকি কেউ নিতে চান না। জয়নালের ভাষ্য, কয়েকজন নেতার সিন্ডিকেট এসব ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণ করে। একেক নেতার স্টিকারে সাংকেতিক চিহ্ন থাকে। যা থেকে বোঝা যায় এ রিকশা কোন ব্যক্তির অধীনে। নেতারা তাদের লোকদের মাধ্যমে টাকা তুলে প্রতি মাসে থানায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে দেন। এছাড়া অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের জন্য ট্রাফিক পুলিশের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকারও তথ্য পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্রাফিক জোন ভিত্তিক চাঁদাবাজির টাকা পৌঁছে দেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সময়মতো টাকা না পেলেই তারা বিশেষ অভিযানের নামে অবৈধ এ যান ধরপাকড়ে নামে। বেশকিছু হলুদ সাংবাদিকও চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পান। এদের কেউ কেউ এলাকাভিত্তিক সাংবাদিক সংগঠন গড়ে তুলে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের টিকিট বিক্রি করেন। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত যানবাহন থেকে মাসে গড়ে ১৫শ' টাকা করে চাঁদা তোলা হলে বছরে এ টাকার অংক এসে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২শ' কোটি টাকা। তবে বাস্তবে চাঁদাবাজির এ অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। কারণ বেশকিছু এলাকায় রিকশাপ্রতি দুই হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এছাড়া কোনো কোনো এলাকায় দৈনিক ভিত্তিতে এক থেকে দেড়শ' টাকা চাঁদা নিচ্ছে স্থানীয় সিন্ডিকেট। তবে একাধিক থানার ওসি, জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার ও ডিসি পর্যায়ের কর্মকর্তারা কেউই ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে বিপুল অংকের অর্থ চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেননি। পুলিশের এসব কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও থ্রি-হুইলার অটোরিকশা নিষিদ্ধ। এসব যানবাহন বিভিন্ন অলিগলিতে ফাঁক-ফোকর দিয়ে চলাচল করে। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট থাকতে পারে। তবে তাদের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। এদিকে ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের দাবি, আইন অনুযায়ী এগুলোর চলাচল বন্ধে কাজ করছে পুলিশ। তবে 'মানবিকতার খাতিরেও' কখনো কখনো ছাড় দিতে হচ্ছে। যদিও চালক-মালিকরা বলছেন, 'মানবিকতা'র দোহাই দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে মোটা অংকের চাঁদাবাজি করছে। টাকা ছাড়া কেউ কোনো 'মানবতা' দেখাচ্ছে না। সড়ক থেকে নিয়মিত অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে অভিযান চালানোর কথা তুলে ধরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো অবৈধ হলেও ঢাকায় চলছে, এই সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে হাইকোর্টের রুল থাকলেও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে তারা তেমন কিছু করতে পারছে না। তবে ট্রাফিক বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিদিন এসব অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করে ডাম্পিং করা হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে শত শত কোটি টাকার চাঁদাবাজির বিষয়টি 'ওপেন সিক্রেট' বলে দাবি করেন মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে চাঁদা আদায় নিয়ে মিরপুরে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যে, আবার কখনো চালকদের সঙ্গে কিছুদিন পরপরই সংঘাত হচ্ছে। ২০২১ সালের ১৬ মে পলস্নবীতে ব্যবসায়ী সাহিন উদ্দীন খুন হলে সন্দেহভাজন হিসেবে চাঁদা আদায় চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান পলস্নবীর ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, সাহিন উদ্দীন হত্যাকান্ডের পর চক্রের কয়েকজন গ্রেপ্তার হওয়ায় চাঁদাবাজিটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে থেকেই তারা আওয়াজ দিচ্ছিল যে, নির্বাচনের পরের মাস থেকে তাদের কাছ থেকে টোকেন কিনতে হবে। এখন এ বাণিজ্য পুরোদমে চলছে। খোরশেদ আলম জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশায় এখন কিউআর কোড দিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে। কিউআর টোকেন হচ্ছে একটি টিনের বোর্ড, যেখানে শুধু একটি কিউআর কোড থাকে। সেটি পাওয়ার জন্য মাস প্রতি রিকশা মালিককে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে দিতে হয়। ওই টাকা দিলে কিউআর কোড সংবলিত বোর্ডটি রিকশার সিটের নিচে লাগিয়ে দেওয়া হয়। চাঁদাবাজদের লোকজন সবসময় রাস্তায় নজরদারি করেন। সন্দেহ হলে তারা রিকশা থামিয়ে সিট উল্টে কিউআর কোড মোবাইল ফোনে স্ক্যান করে নেয়। তাতেই রিকশার সব তথ্য চলে আসে, রিকশা মালিক চাঁদা দিয়ে হালনাগাদ আছে কিনা, তাও জানা যায়। মাসের চাঁদার টাকা পরিশোধ না করলে তারা রিকশার ব্যাটারির তার কেটে দেয়, রাস্তায় চলতে দেয় না। স্থানীয়রা জানান, শুধুমাত্র পলস্নবী এলাকায় ৮ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। প্রতিটি রিকশা থেকে মাসে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হলে বছরে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক-চালকরা জানান, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকাতেই একাধিক গ্রম্নপ এ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। তবে ক্ষমতার আধিপত্য অনুযায়ী তারা এলাকা ভাগ করে নেন। এ কারণে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে তেমন সংঘাত হয় না। ট্রাফিক ও থানা পুলিশ আলাদাভাবে চাঁদা আদায় করে। কোনো কোনো থানা পুলিশ ব্যাটারিচালিত রিকশার যেসব গ্যারেজে অবৈধভাবে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয় সেখান থেকে চাঁদা তোলে।