তিন বিদেশি বড় শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করেছিল বলে দাবি করেছেন, জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের। শনিবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
দলের তৃণমূলের নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে কেন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, '৭ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে বৈঠকে করে পরিষ্কার বুঝেছিলাম, তিনটি বিদেশি বড় শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে এবং নির্বাচন সফল করতে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু তারা নয়, আরও বেশ কয়েকটি বিদেশি শক্তি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করতে প্রস্তুত ছিল।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, 'নির্বাচন বন্ধ করে কোনো দেশে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই জাতীয় পার্টি নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করছে। নির্বাচনের আগে বর্ধিত সভায় নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মতামত দেওয়া হয়েছিল। ভোটে না গেলে ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রাখা যাবে কী না সন্দেহ ছিল, তাই নির্বাচনে গিয়েছি। আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। ভোটের আগ মুহূর্তে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তখন সুষ্ঠুভাবে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেছি। মনে হয়েছে, বিভিন্ন বিদেশি শক্তি বিভিন্নভাবে পরিস্থিতি নানা দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।'
জি এম কাদের বলেন, আর বিএনপির আন্দোলন নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল, তারা সফল হবে না। আন্দোলন চলাকালে তৃতীয় শক্তি এসে সরকার পরিবর্তন করে, এমন ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। ফলে, বিএনপির ১ কিংবা ১০ লাখ বা ১ কোটি লোক নিয়ে রাস্তায় নামলেও বিএনপির আন্দোলন সফল হবে না, তা বুঝতে পেরেছিলাম।
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপি ও জামায়াত আন্দোলনে পরাস্ত হয়ে জাতীয় পার্টিকে দোষ দিচ্ছে। তবে এটা ঠিক নির্বাচন ভালো হয়নি।
সরকার জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত দল হিসেবে দেখতে চায়, যা কখনও সম্ভব নয়। জাতীয় পার্টি কখনই অনুগত বিরোধী দল ছিল না এবং জাতীয় পার্টি গৃহপালিত বিরোধী দল হতে রাজি না।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরে দলের প্রথম বর্ধিত সভাটি ডাকা হয়েছিল জাতীয় পার্টিতে নতুন করে ভাঙনের পরিপ্রেক্ষিতে। সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বারবার ভাঙনের মুখে থাকা দলটি সবশেষ ব্র্যাকেটবন্দি হয়েছে নির্বাচনের পর।
এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আলাদা কমিটি গঠন হয়েছে, যে কমিটিতে বেশ কয়েকজন নেতার নাম রয়েছে যারা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে কমিটিতেও আছেন। এই অবস্থায় এই সভা ডাকা হয়।
একইদিন রওশনের কমিটির পরিচিতি সভা হওয়ার কথা ছিল। তবে গরমের কারণ দেখিয়ে সেই সভা স্থগিত করা হয়।
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, "(২০২৩ সালের) ১৬ ডিসেম্বর রাতে সবাইকে (দলের প্রার্থী) জানিয়ে দিলাম নির্বাচনে যাব না। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর সকালে আমার উপরে প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে চাপ আসল। প্রত্যক্ষভাবে সেটা বলব না, কিন্তু পরোক্ষভাবে হলো, আমাদের দলের ভেতরে কোন্দল তৈরি করে দল ভেঙে দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, "২৬ জনের তালিকা দেওয়া হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেখানে জাতীয় পার্টির ক্যান্ডিডেট দিল সেখানে স্বতন্ত্র পাওয়ারফুল প্রার্থীও রেখেছে।"
কেবল কয়েকটি আসনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, "সরকার যাকে পাস করাতে চায়, তাকে পাস করানো হয়েছে। আমি যেই আসনে নির্বাচন করেছি, সেখানেও আমাকে হারানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। আমাকে ধ্বংস করা মানে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করা।"
জাতীয় পার্টি না গেলে নির্বাচনের 'গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না' বলে আওয়ামী লীগ তাদেরকে চেয়েছে বলেও মনে করেন সংসদে বিরোধী দলটির নেতা।
তিনি বলেন, "আওয়ামী লীগ আমাদেরকে ব্যবহার করে একদলীয় রাজত্বের চিন্তা করেছে। তারা চেয়েছে অনুগত বিরোধীদল। তারা আমাদের গলায় পচা, গলা, মরা আবর্জনা ঢুকিয়ে দিয়ে অনুগত বিরোধীদল বানানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা আমরা হইনি।"
দলের কিছু নেতা জাতীয় পার্টির ছবি না দিয়ে আওয়ামী লীগের ছবি দিয়ে পোস্টার করে জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, "এটা পার্টি মানবে না। যারা গৃহপালিত বিরোধী দল হতে চায়, চলে যান। আমরা হব না।
গৃহপালিত হলে রাজনৈতিক মাঠে হারিয়ে যাবেন, আমি ছাড় দেব না।"
শেরীফা কাদেরের মনোনয়ন কেন?
এবারের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসনে স্ত্রী শেরীফা কাদেরকে প্রার্থী করা নিয়ে জাতীয় পার্টিতে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে তা নিয়েও কথা বলেন জি এম কাদের।
দলের একাংশের নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এই আসনটিতে ছাড় নিশ্চিত করার জন্যই ভোটে না যাওয়ার কথা বলছিলেন জি এক কাদের। পরে এই আসনটি পেয়ে ঢাকায় দলের দুইজন সংসদ সদস্যের আসন ছেড়ে দেন তিনি।
তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, "উত্তরা আমাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমি দীর্ঘদিন এ এলাকায় রাজনীতি করেছি। ১০টি আসনের চেয়ে উত্তরার এই আসন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি চেয়েছি দলের শক্তিশালী অবস্থানের জন্য আমার স্ত্রী এখান থেকে নির্বাচন করুক।"
দলে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, "আমাকে কমপক্ষে ১০০ জন নেতাকর্মী দিনরাত ফোন দিয়ে বলে, 'টাকা দেন, টাকা দেন'। অথচ তারা নির্বাচনে নাই, রাজনীতির মাঠেও নাই।
"তারা বলেছে আমি নাকি দল বিক্রি করে দিয়েছি, আমি নাকি মনোনয়ন বাণিজ্য করেছি। কোনো মনোনয়ন বাণিজ্য করি নাই। কারও কাছ থেকে এক টাকা নেই নাই।"
প্রজাতন্ত্র না রাজতন্ত্র
আওয়ামী লীগ প্রজাতন্ত্রের জায়গায় রাজতন্ত্র কায়েম করছে বলেও মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, "জনগণ ভোট দিতে চায় না, এটা হচ্ছে বিরাজনৈতিকরণ। এসব করে আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাজনৈতিক দলের চরিত্র হারিয়েছে।"
জি এম কাদের বলেন, "আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কথা বলে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের স্পেস দেওয়া হচ্ছে না। ক্ষমতা সব এককেন্দ্রিক। উনার (প্রধানমন্ত্রী) ইচ্ছায় ভোট হয়।
"কেউ ভোট করলে উনার অনুমতি নিয়ে করতে হবে। এভাবে চললে দেশে কোনো দলই টিকবে না। এখন এমন অবস্থা করা হয়েছে যে, রাজনীতি করলে হয় ফুলের মালা না হয় ফাঁসির দড়ি গলায় নিতে হবে।"
'বিএনপি ভুল করে এখন আমাকে দোষ দেয়'
আন্দোলন করতে নেমে বিএনপি কিছু ভুল করেছে বলেও মনে করে জাতীয় পার্টির এ নেতা।
তিনি বলেন, "আমি জানতাম বিএনপির আন্দোলনে সরকার পতন সম্ভব না। ১০ লাখ নয়, ১ কোটি মানুষও রাস্তায় নামলে নির্বাচন বন্ধ হবে না।"
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের দিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে জি এম কাদের বলেন, "বিএনপি কিছু ভুল করে ফেলল। তারা ফাঁদে পড়ে গেল। নেতৃস্থানীয় লোকজন গ্রেপ্তার হলো, আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হলো।
"বিএনপি আন্দোলনে পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু তারা এ দায় আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তারা বলে, আমি না গেলে নাকি নির্বাচন হতো না। বিএনপি-জামায়াতের নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য আমার উপরে দোষ দেয়।"
'এরশাদের প্রতিনিধিত্ব করে একমাত্র জিএম কাদের'
বর্ধিত সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, "গত নির্বাচনে আমাদের নিজেদের কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আমরা প্রত্যাশিত ফলাফল পাইনি।
"আমাদের নেতাকর্মীদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে জয়ী হতে পারিনি।"
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে অল্পের জন্য পরাজয় থেকে রক্ষা পাওয়ার কথাও তুলে ধরেন চুন্নু। তিনি বলেন, "আমাকেও লড়াই করে জয়ী হতে হয়েছে। আমাদের ত্যাগী কিছু নেতাকর্মী আমাদের ভুল বুঝে চলে গেছেন। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই দেশে এরশাদের প্রতিনিধিত্ব করে একমাত্র জিএম কাদের, অন্য কেউ এরশাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই যারা চলে গেছেন তারা ভুল করেছেন।"
দলের কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, সালমা ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। প্রেসিডিয়াম সদস্য নাজমা আক্তার, ফখরুল ইমাম, নাসরিন জাহান রত্না, চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরীফা কাদেরও বর্ধিত সভায় অংশ নেন।