দেশজুড়ে বয়ে যাওয়া টানা দাবদাহের মধ্যে তাপমাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। এর সঙ্গে বৃষ্টি হওয়ার মতো স্বস্তির খবরও দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শনিবার চুয়াডাঙ্গায় পারদ চড়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে; যা এই মৌসুমের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এদিন ঢাকায় ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিবদ্ধ করা হয়েছে। শুক্রবার মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল চুয়াডাঙ্গায়। আর ঢাকায় ছিল ৩৮ দশমিক ২।
চলমান দাবদাহে জনজীবনে দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। হাঁসফাঁস করছে মানুষ। নির্ঘুম রাত কাটছে অনেকের। তাপমাত্রা সামান্য কমলেও তা দুর্ভোগ পরিস্থিতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। স্বস্তি ফেরেনি জনজীবনে। কক্সবাজার এবং নরসিংদীতে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রংপুরে গত ৫ দিনে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ২২ জনের মৃতু্য হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তৃতীয় দফায় দেওয়া সতর্কতা শেষ হচ্ছে আজ। তবে গরম না কমায় ফের চতুর্থ দফার সতর্কতা
জারি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, 'মে মাসের ২ তারিখের দিকে বৃষ্টি হতে পারে। এটা কয়েকদিন থাকার সম্ভাবনা আছে, তখন তাপমাত্রা কমবে। এবার বৃষ্টিপাতের প্রবণতা না থাকায় চৈত্র মাসের শেষ সময় থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। চলতি মৌসুমে ৩১ মার্চ থেকে দাবদাহ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়তে থাকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত টানা ২৮ দিন ধরে দাবদাহ চলছে। গত বছর ১৭ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। এ বছরও কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে।
দেশের তিনটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অতি তীব্র দাবদাহ। আর পাঁচটি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। মাঝারি দাবদাহ বিভিন্ন অঞ্চলে। একদিকে দাবদাহ, অন্যদিকে মাঠে মাঠে পাকা ধান। এতে চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক। তীব্র গরমে মিলছে না প্রত্যাশিত কৃষিশ্রমিক। এতে সময়মতো ধান ঘরে তোলা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
চুয়াডাঙ্গা পুড়ছে ৪২.৬ ডিগ্রিতে
স্টাফ রিপোর্টার, চুয়াডাঙ্গা জানান, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা। শনিবার বিকাল ৩টায় এই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ মো. জামিনুর।
তিনি আরও জানান, বাতাসের আদ্রর্তা বেশি অর্থাৎ বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেশি থাকার কারণে ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। এখন এই জেলায় অতি দাবদাহ চলছে। আরও ৪-৫ দিন এ অবস্থা থাকতে পারে। এরপর মে মাসের কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
হিটস্ট্রোকে দুইজনের মৃতু্য
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, শনিবার সকালে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ঘুরাঘুরির সময় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মতিউর (৪০) নামে এক পর্যটকের মৃতু্য হয়েছে। তিনি কুমিলস্নার বুড়িচংয়ের বাসিন্দা।
কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, 'মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। নিহতের স্বজনদের খবর দেওয়া হয়েছে।'
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আশিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই ওই পর্যটকের মৃতু্য হয়। হিটস্ট্রোকে নাকি অন্য কোনো রোগে তিনি মারা গেছেন, তা ময়নাতদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এদিকে, নরসিংদীর রায়পুরায় সওদাগর কান্দি এলাকায় হিটস্ট্রোকে ইয়াসিন নামে দেড় বছরের এক শিশুর মৃতু্য হয়েছে। শিশু ইয়াসিন উপজেলার চাঁনপুর ইউনিয়নের সওদাগর কান্দি গ্রামের প্রবাসী এনামুল হকের ছেলে।
ইয়াসিনের নানা বাচ্চু মিয়া জানান, নাতিসহ তার মেয়ে নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকার ভাড়া বাসা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি সওদাগর কান্দিতে এসে দুপুর সোয়া ২টার দিকে সে তার মায়ের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় অতিরিক্ত গরমে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তাকে সওদাগর কান্দির ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সাব সেন্টারে নিয়ে গেলে সেখানকার দায়িত্বরত ফার্মাসিস্ট মিজানুর রহমান তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সবাই বলছে, হিটস্ট্রোকে সে মারা গেছে।
রংপুর ৫ দিনে ২২ জনের মৃতু্য
রংপুরেও বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। দাবদাহে হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। রংপুর বিভাগের একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে তিল ধারণের জায়গা নেই। এর মধ্যে মেডিসিন ওয়ার্ডের বেশিরভাগ সিলিং ফ্যান নষ্ট থাকায় রোগীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন রংপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে ৮-১০ জন হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন। গত পাঁচ দিনে হিটস্ট্রোক করা ২২ রোগী মারা গেছেন।
সরেজমিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, কার্ডিওলজি ও মেডিসিন বিভাগে রোগীদের প্রচন্ড চাপ। ওয়ার্ডগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে আসা রহমান আলী জানান, তিন দিন ধরে ভর্তি আছেন। একদিকে চিকিৎসার নামে প্রহসন, অন্যদিকে প্রচন্ড গরম।
একই কথা জানালেন রংপুরের পীরগাছা থেকে আসা মমতাজ বেগম, আনোয়ারা বেগম, কুড়িগ্রাম থেকে আসা আশরাফ আলীসহ অনেকেই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, 'ওয়ার্ডের সিলিং ফ্যানগুলো সচল আছে। বিকল হলেই সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। হাসপাতালে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত অনেক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে মারা যাওয়ার বিষয়টি ওইভাবে বলা যায় না। কেননা, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেক রোগীই মারা যায়- এটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে শয্যা সংখ্যার ২-৩ গুণ বেশি রোগী থাকায় বাড়তি চাপ পড়ছে। এরপরও চেষ্টা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।'
রাস্তায় পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি
তীব্র দাবদাহ থেকে নগরবাসীর স্বস্তির জন্য রাজধানীর সড়কে পানি ছিটিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত সপ্তাহে কিছু কিছু এলাকায় পানি ছিটানো শুরু হলেও শনিবার আগারগাঁওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'এখন থেকে প্রতিদিন ডিএনসিসির ১২টি গাড়ি দিয়ে নগরের বিভিন্ন সড়কে পানি ছিটানো হবে। বিভিন্ন প্রধান সড়কে দুটি ওয়াটার ক্যানন দিয়ে আর বিভিন্ন ছোট সড়কে ১০টি ওয়াটার বাউজার দিয়ে পানি দেবে ডিএনসিসি।'
মেয়র আতিক রাজধানীর পথচারীদের পানি পানের সুবিধার জন্য প্রতিটি দোকানের সামনে একটি পানির ড্রাম এবং একটি গস্নাস রাখতে দোকানদারদের প্রতি অনুরোধ জানান।
বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসলিস্নরা
তাপপ্রবাহের বিস্তার ঘটেছে দেশে। এতে বিপর্যস্ত জনজীবন। সহসাই বৃষ্টি আসবে, তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। আর সে কারণে বৃষ্টির আশায় শনিবারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় এস্তেস্কার নামাজ আদায় করেছেন মুসলিস্নরা। নামাজ শেষে অঝোরে কেঁদেছেন শত শত মুসলিস্ন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের ঈদগাহ মাঠে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় এই নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ আদায় শেষে খুতবা পাঠ করা হয় ও আলস্নাহর কাছে বৃষ্টি চেয়ে দোয়া প্রার্থনা করা হয়। এ সময় শত শত মুসলিস্নর কান্না ও আমিন আমিন ধ্বনিতে ভরে ওঠে ঈদগাহ মাঠ।