দেশজুড়ে এখনো মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে চললেও এর মধ্যেই আজ খুলছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে সরকারি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকছে। তাপপ্রবাহ না কমা পর্যন্ত স্কুলে অ্যাসেম্বলি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিখন ঘাটতি পূরণ এবং নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন ফল অর্জনের জন্য পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত শনিবারও শ্রেণি কার্যক্রম চলবে। অর্থাৎ এখন থেকে সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস হবে।
এদিকে তীব্র গরমে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া এবং গনগনে সূর্যতাপে অগ্নিকুন্ডতে পরিণত হওয়া শীততাপ নিয়ন্ত্রণহীন শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করতে গিয়ে সন্তানরা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হবে কিনা, কিংবা ডায়রিয়া, ঠান্ডা-জ্বরসহ গরমজনিত অন্য কোনো রোগে পড়বে কিনা তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা।
তাপমাত্রা পরিবর্তনের কোনো সুখবর না থাকলেও চলমান দাবদাহের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের ভাষ্য, দেশে অন্তত ৪৫টি জেলায় এখনো মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। গ্রামগঞ্জের বিপুলসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিনের চালার। অনেক স্কুল পর্যাপ্ত ফ্যানও নেই। গ্রামাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে স্কুলে আসতে হয়। শহরাঞ্চলে স্কুল-কলেজে যেতে অনেক শিক্ষার্থীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে। এ পরিস্থিতিতে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কিংবা অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকা ক্লাস রুমে কোনো শিক্ষার্থী বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তার দায় কে নেবে- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা।
অন্যদিকে সরকারি নির্দেশনা মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা
রাখার পক্ষে প্রকাশ্যে সায় দিলেও শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ শিক্ষকরাও। তাদের ভাষ্য, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যগ্রহণ করে। ফলে তীব্র গরমে তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়।
শনিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোসাম্মৎ রহিমা আক্তারের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রোববার থেকে এক শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা ক্লাস চলবে। দুই শিফটে পরিচালিত স্কুলগুলোয় প্রথম শিফট সকাল ৮টা থেকে সকাল সাড়ে ৯টা এবং দ্বিতীয় শিফট পৌনে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলমান থাকবে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ। দাবদাহ সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অ্যাসেম্বলি বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়া শ্রেণি কার্যক্রমের যে অংশটুকু শ্রেণিকক্ষের বাইরে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসতে হয়, সেসব কার্যক্রম সীমিত থাকবে। দাবদাহসহ অন্য কারণে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় যে শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা পূরণ এবং নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন ফল অর্জনের জন্য পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত শনিবারও শ্রেণি কার্যক্রম চলবে। অর্থাৎ সপ্তাহে পাঁচ দিন নয়, এখন থেকে ছয় দিন স্কুলে যেতে হবে শিক্ষার্থীদের।
এর আগে বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২৮ এপ্রিল রোববার থেকে যথারীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে এবং শ্রেণি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দাবদাহ সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অ্যাসেম্বলি বন্ধ থাকবে। দাবদাহ এবং অন্য কারণে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে যে শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পূরণ এবং নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন ফল অর্জনের জন্য পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত শনিবারও শ্রেণি কার্যক্রম চলবে।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে এক সপ্তাহ বন্ধের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দেশের সব কলেজে যথারীতি ক্লাস শুরু হচ্ছে আগামীকাল রোববার। শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক মো. আতাউর রহমানের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, আজ রোববার থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহে ক্লাস যথারীতি চলবে। এদিকে, গত রোববার থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রয়েছে।
এ তীব্র দাবদাহের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক অভিভাবক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, আর এক সপ্তাহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে কী এমন ক্ষতি হতো? কিন্তু এই তাপমাত্রার মধ্যে শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে গেলে বরং ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, শিশুদের সহনীয় ক্ষমতা কম। তাই এই তাপমাত্রার মধ্যে শিশুদের কোনোভাবেই ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে শিশুরা বাইরে গেলে নানা ধরনের রোগব্যধিতে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখাই ভালো।
ওই চিকিৎসকের ভাষ্য, তীব্র গরমে হাসপাতালগুলোয় শিশু রোগী কানায় কানায় পূর্ণ। তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় নতুন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
রাজধানী ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেন, তাদের সন্তানরা সরকারি স্কুলে পড়েন না। তারা হয় বিদেশে, না হয় দেশের নামিদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করে। সেখানে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। তাই সাধারণ শিক্ষার্থী এই তীব্র গরমে কীভাবে ক্লাস করবে তা তারা বুঝতে পারেন না।
নাজনীন আকতার নামে এক অভিভাবক এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তীব্র গরমে ঘরে ফ্যানের নিচেই বসে ঘেমে নেয়ে উঠছে। সেখানে গাদাগাদি করা ক্লাসে ছেলেমেয়ে কীভাবে ক্লাস করবে?
ওই অভিভাবকের ধারণা, এই গরমের সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন না। ফলে শিক্ষকরা স্কুলে এসে ক্লাস নিতে সেভাবে উৎসাহ পাবেন না। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকার হয়তো শিগগিরই এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।