ঝিনাইদহে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

প্রকাশ | ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
তীব্র তাপপ্রবাহে সারাদেশের মতো পুড়ছে ঝিনাইদহ। পুড়ছে মাঠের ফসল। হাঁসফাঁস করছেন মানুষ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে ৩৫ থেকে ৪০ ফুট। পানি উঠছে না জেলার হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপে। পানির জন্য গ্রামে গ্রামে পাড়া-মহলস্নায় হাহাকার শুরু হয়েছে। মানুষ যেখানে পানির সন্ধান পাচ্ছে, সেখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। গরমে গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশু-পাখির পানির উৎসেরও সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। হুমকির মুখে পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এমন অবস্থায় সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইরি ধানের মাঠে সেচকাজে মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় পানির স্তর নেমে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে কোনো নিয়ম না মানায় এমনটি হয়েছে বলে তাদের দাবি। এদিকে গ্রীস্মের শুরুতেই জেলার ১০ নদী ও ২ নদের প্রায় ৮০ শতাংশ শুকিয়ে গেছে। এসব নদ-নদীতে কৃষকদের ধানের চাষ করতে দেখা গেছে। মানুষের অব্যাহত অনিয়মে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে বলেও তাদের মত। আর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। দিনে দিনে পরিবেশ তার নিজস্ব ভাবরসাম্য হারিয়ে ফেলছে। গত এক দশকে জেলার নদ-নদী তার নাব্য হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় অর্ধশতাধিক দেশীয় মাছ। ফলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এখনি সচেতন না হলে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চল মানুষের বসবাস হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলেও জানিয়েছেন তারা। জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রীষ্ম মৌসুম এলে কিছুটা পানির সংকট দেখা দেয় কিন্তু এ বছর একটু বেশি সমস্যা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় মানুষের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কাজ করছে। কমিউনিটি বেজ ওয়াটার সাপস্নাই প্রজেক্টের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর আওতায় প্রতি উপজেলায় ১৮টি করে ওয়াটার সাপস্নাইয়ের ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে শৈলকুপায় ৩০০ ও মহেশপুর উপজেলায় প্রায় ৩০০ পরিবারের সারাবছর পানি সাপস্নাইয়ের জন্য গভির নলকূপ স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এখানে ১ লাখ সুউচ্চ জলধার বিশিষ্ট পানির ট্যাংক স্থাপন করা হচ্ছে। ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। কাজ শেষ হলে আগামী ৫০ বছর সংশ্লিষ্ট কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা পাবে। এ ছাড়া মহেশপুর ২০ এবং শিঘ্রই হরিনাকুন্ডু উপজেলায় ২০টি করে কমিউনিটি বেজ ওয়াটার সাপস্নাই জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু করা হবে। এদিকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় কাজ করা পানি শ্রমিকরা বলছেন, সাধারণত ২০ থেকে ২৫ ফুট মাটির নিচে পানির লেয়ার বা স্তর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন নলকূপ স্থাপন করতে গিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ ফুট নিচেও পানির লেয়ার মিলছে না। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ ফুট নিচে পানির স্তর থাকলে মোটর বা হস্তচালিত নলকূপে পানি ওঠে। কিন্তু ঝিনাইদহসহ আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় হস্তশালিত নলকূপে পানি উঠছে না। জানা গেছে, জেলার জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর হিসেবে তাদের নির্ধারিত ডিজাইন মেনে ঝিনাইদহের ছয় উপজেলায় প্রায় ৩১ হাজার নলকূপ রয়েছে। সেসব নলকূপে পানির কোনো ঘাটতি নেই। এ ছাড়া জেলার কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন বলছে তাদের অনুমোদিত নিয়ে জেলায় প্রায় ২০০ গভীর এবং ৭ হাজার ৯২১টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। তবে তাদের অনুমতি ছাড়াই ব্যক্তি উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েক হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপ থেকে নিয়ম না মেনে যত্রতত্র পানি উত্তোলন করায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এ ছাড়া জেলায় প্রায় ৩ লাখ নলকূপ রয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ নলকূপ এখন পানি উঠছে না। জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, গেল বর্ষা মৌসুমে আশানুরূপ বৃষ্টি না হওয়ায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বর্তমান মাঠে থাকা ইরিধানের জমিতে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ দেওয়া এবং গরমের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের টিউবয়েল ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান জানান, সাধারণত ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচে পানির লেয়ার বা স্তর পাওয়া যায় কিন্তু এখন নলকূপ স্থাপন করতে গিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ ফুট নিচে পানির লেয়ার মিলছে না। জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলা কাঁঠালিয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক শফিকুর রহমান জানান, গত কয়েকদিনে প্রচন্ড দাবদাহ। এরই মধ্যে টিউবওয়েলের পানি উঠছে না। মোটরচালিত টিউবওয়েলেও পানি উঠছে না। কিছু চাপকলে পানি উঠলেও তা একেবারেই কম। শৈলকুপা উপজেলার আবাইপুর গ্রামের ইলাপি খাতুন বলেন, আমাদের টিউবওয়েলে প্রচুর পরিমাণে পানি উঠত কিন্তু এখন আর পানি উঠছে না। এক কিলোমিটার দূরের একটি মসজিদ থেকে পানি নিয়ে এসে কাজ করছি। কামরুন নাহার নামে এক বৃদ্ধা বলেন, টিউবওয়েলে পানি উঠছে না দুই মাস ধরে। তারপর প্রচন্ড গরম, খুব কষ্ট পাচ্ছি। একই গ্রামের মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, গরমের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাপর টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে স্বল্প খরচে গভীর নলকূপ স্থপান করতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে স্থাপন করতে প্রায় ৮০ হাজার টাকা লাগে, যা আমাদের সবার পক্ষে সম্ভব নয়। জেলার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মাসুদ আহম্মদ সঞ্জু জানান, দেশের মধ্যে চরম ক্ষরাপ্রবণ এলাকা ঝিনাইদহ। গবেষণা বলছে মরু এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। দেশের অন্য এলাকা থেকে জলাশয়ও কম। সরকারের নিয়ম আছে এক কিলোমিটারের মধ্যে গভীর নলকূপ করা যাবে না কিন্তু এ নিয়ম কেউ মানছে না। পানি প্রবাহের উৎস নদনদী ভরাট করে দখল হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এখন পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে নদী খনন করতে হবে। নিয়ম মেনে গভীর নলকূপ স্থাপনে নজরদারি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরাই আজকের এ বিপর্যয় ডেকে এনেছি। পুকুর ভরাট করছি, গাছগুলো কেটে ফেলছি। দুবাই সৌদি বর্তমানে আবহাওয়া পরিবর্তন ঘটেছে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সৌদি, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশ থেকে মাটির উপরিভাগ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তারা সবুজায়ন করার চেষ্টা করছে। আর আমরা গাছ লাগাচ্ছি কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ করছি না। এখন গাছ লাগিয়ে যত্ন নিলে আগামী পাঁচ বছর পরে আমাদের পরিবেশ শান্ত হবে। তা না হলে আগামী পাঁচ বছর পর আমাদের পরিবেশ আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। ঝিনাইদহ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম বলেন, নদীনালা খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ ফুট নিচে পানির স্তর থাকলে মোটর বা হস্তচালিত নলকূপের পানি ওঠা সম্ভব হয়। কিন্তু ঝিনাইদহের অধিকাংশ এলাকায় ৩৫ থেকে ৪০ ফুট পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় ১৮টি করে কমিউনিটি বেজ গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে। একটি নলকূপ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ পরিবার সুপেয় পানির সুবিধা পাবে।