শিশু পর্নোগ্রাফির তদন্তে ইন্টারপোল
১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে দায় স্বীকার টিপুর জড়িত সাতজন শনাক্ত
প্রকাশ | ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
শিশুদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরির ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল। এছাড়া অস্ট্রোলিয়া ও ইতালি বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তদন্তে নেমেছে। তদন্তে যুক্ত হচ্ছে জার্মানিসহ যেসব দেশে শিশু পর্নোগ্রাফি বিক্রি হয়েছে, সেইসব রাষ্ট্র। তদন্তকারী দেশগুলো শিশুদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি ও বাজারে ছেড়ে দেওয়াকে মারাত্মক আন্তর্জাতিক শিশু অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ইতোমধ্যে সামান্য টাকার প্রলোভনে ফেলে শিশু জোগাড়কারী সাতজন শনাক্ত হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফির বাংলাদেশ অংশের প্রধান টি আই এম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া (৫৭) ও তার সহযোগী কামরুল ইসলাম ওরফে সাগরকে (২০) গ্রেপ্তারের খবরে রীতিমতো বহির্বিশ্বে হইচই পড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, শিশু অধিকার থেকে শুরু করে নানা সংগঠন এমন ঘটনার কড়া সমালোচনা করছে। অনেক বিদেশি রাষ্ট্রে সমকামিতা বৈধ হলেও শিশুদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং মারাত্মক শিশু অপরাধ।
সূত্রটি বলছে, টিপু কিবরিয়ার শিশু পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট তৈরি ও তা বিদেশে বিক্রির বিষয়টি নজরে আসার পর বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ঘটনাটির নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে। যদিও ইন্টারপোলের তথ্যের সূত্র ধরেই ২০১৪ সালে সিআইডি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন টিপু। সাত বছর জেল খেটে ২০২১ সালে মুক্তি পান তিনি।
সিটিটিসির একজন ঊর্ধ্বতন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানান, টিপু কারামুক্ত হওয়ার পর আবারও শিশু সাহিত্যের চর্চা শুরু করেন। তবে তার ওপর নজরদারি অব্যাহত ছিল দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ইন্টারপোলের। সবশেষ অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশের সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের সূত্রধরে আবারও শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির দায়ে এক সহযোগীসহ ঢাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। সেই বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুটিকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরির প্রস্তুতি চলছিল। যা টিপু ও শিশুর জবানবন্দিসহ সংগৃহীত আলামত পর্যবেক্ষণে ওঠে এসেছে।
সূত্র জানিয়েছে, জব্দ হওয়া শিশু পর্নোগ্রাফির হাজার হাজার কনটেন্ট, স্থির চিত্র, ভিডিও এবং বিপুল ইলেকট্রনিক ডিভাইস পাঠানো হয়েছে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। ফরেনসিক পরীক্ষায় যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে চক্ষু চড়ক গাছ।
দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা জানান, টিপু সামাজিক যোগাযোগের ২৫ থেকে ৩০টি গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদেশির কাছে বিকৃত যৌনাচারের হাজার হাজার কনটেন্ট পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে শিশু পর্নোগ্রাফির সবচেয়ে বেশি কনটেন্ট পাঠিয়েছেন মেগা ও টেলিগ্রাম নামের দু'টি গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে। অ্যাপস দু'টিতে টাইমিং সেট করা আছে। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের পর অ্যাপস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কনটেন্ট মুছে যাবে। যা আর কোনো সময়ই উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
সূত্রটি বলছে, একমাত্র ডাউনলোড করে রাখলেই ওইসব ভিডিও পরবর্তী সময়ে দেখার সুযোগ থাকবে। এজন্য কোনো কোনো কনটেন্টের স্থায়িত্বকাল এক ঘণ্টা বা এক সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা হয়েছিল। অর্থৎ এক ঘণ্টা বা এক সপ্তাহ পর ওইসব কনটেন্ট চিরতরে মুছে যাবে। তা আর কোনোভাবেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না। টেলিগ্রাম অ্যাপসটি রাশিয়া থেকে পরিচালিত। রাশিয়ায় প্রচুর কনটেন্ট বিক্রি হয়েছে। শিশু পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট কোন বয়সের ও কি ধরনের পেশার পুরুষ না নারীরা কিনেছেন, সে সম্পর্কে জানতে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। শুক্রবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেশটির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি।
দায়িত্বশীল তদন্তকারী এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে আরও জানান, শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ইতোমধ্যেই ইতালি সরকার বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তদন্তে যোগ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে কানাডা ও জার্মানির রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং দেশ দু'টির সরকারি তদন্ত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। ইতোমধ্যেই দেশ দু'টি শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়ে নিজ উদ্যোগে তাদের মতো করে তদন্ত করার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশকে তদন্তে সার্বিক সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেছে।
দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এখন পর্যন্ত তদন্তে শিশু জোগাড়ের দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে সাতজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান চলছে। তাদের পালিয়ে বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে স্থল সীমান্তে ও বিমানবন্দরগুলোতে আগাম বার্তা পাঠানো হয়েছে।
সূত্রটি বলছে, টিপুর তৈরি করা শিশু পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোলা প্রচুর ভুয়া আইডি। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই ভুয়া নামে আইডি খুলেছিল টিপু ও তার চক্রের সদস্যরা। কোন কোন ভুয়া আইডি থেকে একটানা এক সপ্তাহ কনটেন্ট পাঠানো হয়েছে। যেসব ভুয়া আইডি থেকে কনটেন্ট পাঠানো হতো, সেগুলোতে টাইমার দেওয়া ছিল। যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ের পর আইডি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কনটেন্ট মুছে যায়। এমনকি কনটেন্ট মুছেও গেছে। যেগুলো আর কোনোভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব না।
সূত্রটি জানায়, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে টিপুর বাসা থেকে জব্দ হওয়া ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষায় বেশ কিছু বিদেশি শিশু পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট ক্রেতার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা সরাসরি টিপুর সঙ্গে গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কনটেন্ট কিনে নিতেন। এজন্য টিপুকে তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ পাঠাতেন। এমনকি ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমেও বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে টিপুর অর্থ লেনদেন হওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এমন ব্যক্তিগত বিদেশি গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ২৫ জন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিটিটিসির প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, শিশুদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করা একটি মারাত্মক অপরাধ। যা আন্তর্জাতিক আইনেও স্বীকৃত। স্বাভাবিক কারণেই এমন ঘটনার রেশ দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়েছে। এমন অমানবিক অপরাধের সম্মিলিত তদন্ত চলছে। তদন্তে অংশ নিয়েছে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলসহ দেশি-বিদেশি একাধিক তদন্ত ও গোয়েন্দা সংস্থা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, টিপু কিবরিয়া ব্যক্তি জীবনেও বিকৃত শিশু যৌনাচারে বিশ্বাসী এবং অভ্যস্ত। অথচ তিনি বিবাহিত। তার এক স্ত্রী ছাড়াও দুই মেয়ে আছে। বড় মেয়ে দেশের একটি মেডিকেল কলেজে পড়ছে। আরেক মেয়ে ছোট। টিপুর শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও বিক্রি নিয়ে পরিবারের মধ্যে চরম অশান্তি আছে। পরিবারের সদস্যরা বার বার টিপুকে বেআইনি পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অনুরোধের পাশাপাশি রীতিমতো হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। আজেবাজে অভ্যাস ত্যাগ না করলে তার সঙ্গে পরিবারের কেউ বসবাস করবেন না, বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু টিপু কিবরিয়া দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বের হতে পারেননি। তিনি রীতিমতো শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। লোকলজ্জার ভয়ে তার পরিবারের সদস্যরা লোক দেখানো সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন টিপুর সঙ্গে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত (উপকমিশনার হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. আহমেদুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, দুই দিনের রিমান্ড শেষে আসামিদের শুক্রবার বিকালে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আদালত তাদের কারগারে পাঠিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাই বাছাই করতে প্রয়োজন হলে তাদের আবারও রিমান্ডে আনা হবে। আসামিদের কাছে পাওয়া যাওয়া আলামত পাঠানো হয়েছে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মিলেছে বহু অজানা তথ্য। সেসব তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ঘটনাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশস্থ দূতাবাসের মাধ্যমে ইতালি সরকার বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ইতালি সিটিটিসির সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তদন্তের পাশাপাশি এককভাবেও বিষয়টি তদন্ত করার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। দেশটির কোন বয়সের কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত, সে বিষয়ে গভীর তদন্তে সহায়তা করতে ইতালি বাংলাদেশ পুলিশের কাছে সহায়তাও চেয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যেসব দেশের নাম এসেছে সেসব দেশও তদন্তে নামছে। অন্যদিকে ইন্টারপোল আগাগোড়াই বিষয়টির ওপর নজরদারির পাশাপাশি গভীর তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ এপ্রিল রাতে ঢাকার খিলগাঁওয়ের নিজ বাসা থেকে সিটিটিসি টি আই এম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া ও তার সহযোগী কামরুল ইসলাম ওরফে সাগরকে গ্রেপ্তার করে। বাসা থেকে জব্দ হয় ২৫ হাজার শিশু পর্নোগ্রাফির ছবি ও এক হাজারের বেশি ভিডিও কনটেন্ট। পর্নোগ্রাফিতে অংশ নেওয়া শিশুদের প্রায় শতভাগই ঢাকার ছিন্নমূল পথশিশু। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। পাঁচশ' থেকে হাজার টাকার প্রলোভনে ফেলে তাদের দিয়ে ওইসব পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে। বিকৃত যৌনাচারে আনন্দ পাওয়া বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বাসাবাড়ি ছাড়াও বন জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ে তৈরি করা হয়েছে ওইসব ভিডিও কনটেন্ট। ডিভিওগুলো টিপু তার বাসায় থাকা স্টুডিওতে এডিট করে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে বিক্রি করে আসছিলেন।