তীব্র তাপদাহে পুড়ছে মেহেরপুরের জনপদ। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও পাখি। খরতাপে মাঠের ধান-পাট পুড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় মেহেরপুরের তিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। তীব্র গরমে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে পানির সংকট চরমে পৌঁছেছে। অনেক এলাকায় কৃষকের সেচ পাম্পেও ঠিকমতো পানি উঠছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং পুকুর, খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভারী বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলেও ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জেলার সদর উপজেলার, উজুলপুর, কুলবাড়িয়া, নিশ্চিন্তপুর, আমঝুপি, পিরোজপুর, আমদহ, বন্দর, দক্ষিণ শালিকা, বাড়িবাঁকা, বুড়িপোতা, বাজিতপুর, ইছাখালি, কামদেবপুর, গোভিপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অনেক জায়গায় মাঠের শ্যালো মেশিনেও ঠিকমতো পানি উঠছে না। ফলে মানুষ একদিকে খাবার পানি সংকটে ভুগছে, অপরদিকে চাষিরা মাঠে ধান ক্ষেতসহ অন্যান্য ফসলে সেচ দিতে গিয়ে ঠিকমতো পানি না পাওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
উজুলপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, তাদের মাঠে শ্যালো মেশিনে ঠিকমতো পানি উঠছে না। ১০ কাঠা ধানের জমিতে সেচ দিতে গিয়ে চার লিটার ডিজেল কিনতে হয়েছে। যেখানে অন্য সময় এক থেকে দেড় লিটার তেলে সেচ হয়ে যায়। শ্যালো মেশিনে ঠিকমতো পানি না ওঠায় দ্বিগুণ সময় ধরে মেশিন চালাতে হচ্ছে। এমন সমস্যার কারণে কেউ কেউ মধ্যরাতে আবার কেউ কেউ ভোররাতে মাঠে গিয়ে সেচ দিচ্ছেন। তাও কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছেন না। তাদের এলাকার বিভিন্ন মাঠে একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কৃষকেরা।
তিনি আরও জানান, গত দুই দিন থেকে তার বাড়ির টিউবওয়েল এবং আশপাশের টিউবওয়েলেও পানি উঠছে না। ফলে খাবার পানির সংকটে পড়েছেন গ্রামবাসী।
নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলাম বলেন, রোববার এক বিঘা ধানের জমিতে সেচ দিতে গিয়ে ৬ ঘণ্টা ধরে শ্যালো মেশিন চালাতে হয়েছে। ডিজেল কিনতে হয়েছে ৬ লিটার। প্রচন্ড খরতাপে মাঠের ধানপাট পুড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষকেরা চোখে আঁধার দেখছেন।
এদিকে, গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের আমতৈল, মানিকদিয়া, কেশবনগর, শিমুলতলা, রুয়েরকান্দি, সহড়াবাড়িয়া, কাথুলি ইউনিয়নের গাঁড়াবাড়িয়া, ধলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় চলতি শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই সুপেয় পানির সংকট প্রকট দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে ৫০-৬০ ফুট গভীরে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ওইসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে যেমন গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
রুয়েরকান্দি গ্রামের গৃহবধূ রশিদা খাতুন জানান, খাবার ও গৃহস্থালি কাজের পানি নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন বলেন, তার বাড়ির টিউবওয়েলে প্রায় ১৫/২০ দিন পানি নেই। শুধু তার বাড়ি নয়, মানিকদিয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই একই অবস্থা। খাবার পানির জন্য এখানে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। একই অবস্থা তাদের আশপাশের এলাকাতেও। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, আগে ২০-৩০ মিনিট মোটর চালালেই বাড়ির ছাদের পানির ট্যাংক পূর্ণ হয়ে যেত। গত দুই-তিন সপ্তাহ থেকে ঘণ্টাব্যাপী মোটর চালিয়েও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। এভাবে চালাতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে অনেকের বৈদু্যতিক মোটর।
একই গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন বলেন, শুধু হস্তচালিত টিউবওয়েলই নয়, শ্যালো মেশিনেও (গভীর নলকূপ) পানি কম উঠছে। মাঠে আগে যেখানে এক বিঘা জমি ভেজাতে ২ ঘণ্টা লাগত এখন সেই জমি ভেজাতে ৬ ঘণ্টা লাগছে। পাশে মাথাভাঙ্গা নদী আছে। নদীতেও পানি শুকিয়ে গেছে। নদীর মাঝখান দিয়ে এখন মোটর সাইকেল চলছে। তিনি ১৭/১৮ বছর আগে একবার এমনটি দেখেছিলেন।
মুজিবনগর উপজেলার কেদারগঞ্জের আশাদুল গাজি জানান, ভৈরব নদের পশ্চিম-দক্ষিণ এলাকার ভবরপাড়া, রতনপুর, বলস্নভপুর, জগন্নাথপুর, নাজিরাকোনা, বাগোয়ান, গৌরীনগর, পুরন্দরপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের নলকূপে পানি উঠছে না। অনেকে ৮ থেকে ১০ ফুট মাটি খুঁড়ে নিচে মোটর বসিয়ে পানি তোলার চেষ্টা করছেন। মাঠের সেচপাম্পগুলোরও একই অবস্থা। ঠিকমতো পানি না পাওয়ায় শুধু সেচ দিতে গিয়ে কৃষককে দুই থেকে তিনগুণ বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ২০১০ সালে এসব এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। তবে এবারের সংকট বেশি মনে হচ্ছে।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার জানান, পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় বর্তমানে সেচপাম্পগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। বৃষ্টিপাতই একমাত্র সমাধান। তবে পাম্পগুলোকে ১০ থেকে ১৫ ফুট মাটি খুঁড়ে নিচে নামিয়ে দিলে কিছুটা ভালো পানি পাওয়া সম্ভব।
তিনি আরও জানান, চলতি মৌসুমে ১৯ হাজার ৯৭ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। তবে কতভাগ সেচপাম্পে পানি উঠছে না বা কী পরিমাণ পানি কম উঠছে তেমন কোনো পরিসংখ্যান কৃষি বিভাগের কাছে নেই।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আিধদপ্তর মেহেরপুরের নির্বাহী মো. মাকবুলার রহমান জানান, প্রচন্ড খরতাপে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এলাকাবাসীর পানি সংকটসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক সাবমার্সিবল পানির পাম্প এসে গেছে। সেগুলো সংকটপূর্ণ এলাকায় দ্রম্নত বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রতই খাবার পানির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।