দুই শিক্ষার্থীর মৃতু্য
চুয়েট বন্ধ ঘোষণা, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বাসে আগুন
প্রশাসনিক ভবনে তালা দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা
প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রাম অফিস
অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করার পর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) প্রশাসনিক ভবনের মূল দরজায় তালা দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এ ভবনে উপাচার্য, সহউপাচার্য, রেজিস্ট্রারের কার্যালয় রয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তালা দিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রীরা ভবনের নিচে অবস্থান নেন।
এদিকে, এক সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা হল ছাড়বেন না। দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তারা ফের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার মধ্যেই হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেন।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ঘোষণা দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবারের মধ্যেই ছেলেদের এবং শুক্রবার সকাল ১০টার মধ্যেই মেয়েদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।
চুয়েটের ডেপুটি রেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চুয়েটের পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার মধ্যে ছাত্রদের এবং শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ত্যাগ করতে হবে।
এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ে তালা এবং তাদের কাছে জব্দ থাকা দুটি বাসের একটিতে আগুন ধরিয়ে দেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার
দুপুর ১টার দিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুরকৌশল ভবন, আর্কিটেকচার ভবন, কম্পিউটার সায়েন্স ভবন, প্রশাসনিক ভবনেও তালা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাগ্বিতন্ডার ঘটনাও ঘটে।
একইসঙ্গে চতুর্থ দিনের মতো সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। ফলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল।
শিক্ষার্থীরা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে চতুর্থ দিনের মতো তারা চুয়েট গেটে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে অবস্থান নেন। এর আগে বুধবার, মঙ্গলবার ও সোমবার বিকালে একইভাবে সড়কে অবস্থান নেন তারা। বিক্ষোভে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক ব্যবহারকারী রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাই উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন এ সড়কে যাতায়াতকারীরা।
গত ২২ এপ্রিল বিকালে দুই সহপাঠী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক, দুই শিক্ষার্থী হত্যার বিচার দাবি, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা এক শিক্ষকের বহিষ্কারসহ ১০ দফা দাবি পেশ করেন। পস্ন্যাকার্ডে লিখে শিক্ষার্থীরা তাদের ১০ দফা তুলে ধরেন। এ দাবি মেনে নিতে তারা ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। তবে ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও দাবি না মানা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ অব্যাহত রাখবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বিক্ষোভে নেমে পড়েন। এ সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এ সড়কে চলা শাহ আমানত লাইনের একটি গাড়ি। এ ছাড়া ভাঙচুর করা হয় আরও চারটি বাস।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, চুয়েট গেটের দুই পাশে সড়কে ব্যারিকেড দেওয়ার ফলে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রীরা হেঁটে চুয়েট গেট অতিক্রম করছেন। এদিন দুপুরে শহিদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা পুরকৌশল ভবনে তালা দেয়, এরপর কম্পিউটার সায়েন্স ভবনে, আর্কিটেক্ট ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাগ্বিতন্ডা হতেও দেখা যায়।
শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন, 'আমাদের দুই ভাই নিহত হয়েছে। আমরা শান্ত থাকবো কীভাবে। আমাদের একটি দাবিও মেনে নেয়নি প্রশাসন। ফলে আমরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।'
চুয়েটের শিক্ষার্থী মিন্টু আজাদ বলেন, 'একজন শিক্ষক এ নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছেন। ফলে আমরা সুমন দে নামের ওই শিক্ষকেরও বহিষ্কার দাবি করছি।'
শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম বলেন, 'আমরা ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি, আমাদের ১০ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের একটি দাবিও মেনে নেওয়ার আশ্বাস পাইনি। ফলে আমাদের আন্দোলন চলছে।'
২২ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ-সংলগ্ন চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে শাহ আমানত বাসের ধাক্কায় চুয়েটের শিক্ষার্থী শান্ত সাহা ও তৌফিক হোসেন নিহত ও জাকারিয়া হিমু আহত হন।
শান্ত সাহা পুরকৌশল বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী (আইডি-২০০১১০০)। তিনি নরসিংদীর কাজল সাহার ছেলে। আর তৌফিক হোসেন একই বিভাগের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী (আইডি-২১০১০০৬)। তিনি নোয়াখালীর সুধারামের নিউ কলেজ রোডের মোহাম্মদ দেলোয়ারের ছেলে। আহত জাকারিয়া হিমু ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
এ ঘটনায় জড়িত বাসচালক মো. তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার বাসচালক রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার উত্তর ঘাটচেক এলাকার বাসিন্দা। তিনি শাহ আমানত বাসের চালক ছিলেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জেলা বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃতু্যর ঘটনায় বাসচালক ও সহযোগীকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। মূলত দুর্ঘটনার পরপরই বাসচালক ও সহযোগী পালিয়ে যায়। বুধবার দুপুরে বাসচালককে গ্রেপ্তারের পর তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সঙ্গে চুয়েট কর্তৃপক্ষ, পরিবহণ মালিক শ্রমিক প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে নিহতদের পাঁচ লাখ করে ও আহত শিক্ষার্থীকে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম গোলাম মোর্শেদ খানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা ১০ দফা ঘোষণা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তারা নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান। বুধবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা ফের বিক্ষোভ শুরু করলে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।