সূচকের পতন ঠেকাতে শেয়ার দর কমার সর্বনিম্ন সীমা কমিয়ে আনার পর প্রথম দিনই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক তিন বছর আগের অবস্থানে চলে গেছে।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার এ বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইক্স ৬০ পয়েন্ট হারিয়ে ৫ হাজার ৫১৮ পয়েন্টে থেমেছে।
এর আগে ২০২১ সালের ২ মে ডিএসইএক্সের চেয়ে বাজে অবস্থায় ছিল, সেদিন সূচক ছিল ৫ হাজার ৫১৭ পয়েন্টের ঘরে।
আড়াই মাসের কম সময়ে পুঁজিবাজারে ৮১৫ পয়েন্ট সূচক পতনের পর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি বাজারে হস্তক্ষেপ করে।
বুধবার জানানো হয়, এক দিনে শেয়ার দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে ফ্লোর প্রাইসে থাকা তিনটি কোম্পানির শেয়ারের দর কমতে পারবে না।
বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ওই নিয়মে লেনদেন শুরু হয় পাঁচ হাজার ৫৭৮ পয়েন্ট নিয়ে। কিন্তু এক পর্যায়ে সূচক পড়ে যায় ৯৮ পয়েন্ট।
কয়েকবারের চেষ্টায় হারানো সূচক কিছুটা ফিরে পেলেও দিন শেষে বাজার শেষ হয় সূচকের ঘরে আগের দিনের চেয়ে ৬০ পয়েন্ট কম নিয়ে।
সূচকের সঙ্গে কমেছে ডিএসইর লেনদেনও। ৫১১ কোটি টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে এ দিন, আগের দিন হয়েছিল ৬০২ কোটি টাকা।
সপ্তাহের শেষ দিন ৩০০টি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে, বেড়েছে ৬৯টির, ২৭টির দর অপরিবর্তিত ছিল।
দর পতনের সুযোগ কমিয়ে আনার পরও সূচকে বড় পতনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, 'আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী অস্বাভাবিক লেনদেন করছে। তাদের নিবৃত্ত করতে শেয়ারের মূল্য কমার হার বেঁধে দিয়েছে কমিশন।
তিনি বলেন, 'বাজার প্রচুর
\হবিক্রয় চাপে রয়েছে। এতে করে তারল্য পুঁজিবাজার থেকে অর্থবাজারে (ব্যাংক) চলে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার ক্রয় করলে পুঁজিবাজার ঘুড়ে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ বাজারে এখনো অনেক শেয়ার আন্ডার ভ্যালুড (প্রকৃত দরের চেয়ে কম) অবস্থায় রয়েছে। সেখানে বিনিয়োগ আসতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাতে বিনিয়োগ করতে পারে।'
টানা আড়াই মাস ধরেই পুঁজিবাজার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে উত্থান হলেও বেশির ভাগ সময়ে পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে।
এর মাঝে রোজা ও ঈদ চলে আসায় বিনিয়োগকারীরা আশা করেছিলেন ঈদ শেষে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে পুঁজিবজার। কিন্তু ঈদের ছুটির পরও ছন্দে ফেরেনি বাজার। উল্টো পতনের হার বেড়েছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'এত দিন ধরে বাজার পতন হওয়া মানে যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা যথাযথ হচ্ছে না। বাজারের ওপর হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নিচ্ছে না। আমরা প্রত্যাশা করব বিএসইসির এ সিদ্ধান্ত সাময়িক হবে।'
এদিকে সার্কিট ব্রেকারের নতুন নিয়ম চালু করার পর বুধবার রাত থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে বিএসইসির সমালোচন করা হয়। আর বৃহস্পতিবার লেনদেন শুরু হওয়ার আগেই ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে সার্কিট ব্রেকারের নতুন নিয়ম। লেনদেন শুরু কয়েক মিনিটের মধ্যেই দিনের সর্বনিম্ন দামে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিপুল শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে। ফলে লেনদেন শুরুর অল্পসময়ের মধ্যেই সূচকের বড় পতন হয়।
দিনের সর্বনিম্ন দামে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ শেয়ার ও ইউনিট বিক্রির আদেশ লেনদেনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের দর পতনের পাশাপাশি সবকটি মূল্য সূচকের বড় পতন দিয়েই দিনের লেনদেন শেষ হয়।
দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে ৬৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট। বিপরীতে দাম কমেছে ৩০০টি প্রতিষ্ঠানের। আর ২৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৬০ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৫১৮ পয়েন্টে নেমে গেছে।
অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১২ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২১৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
সবক'টি মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৫১১ কোটি ৪৩ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৬০২ কোটি ৭৪ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ৯১ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
এ লেনদেনে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছে ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার। কোম্পানিটির ৩১ কোটি ৬৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লাভেলো আইসক্রিমের ২৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ২৩ কোটি ২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আইটি কনসালট্যান্ট।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- কহিনুর কেমিক্যাল, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, মালেক স্পিনিং, ফার্মা এইড, বিচ হ্যাচারি এবং বেস্ট হোল্ডিং।
অপর শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৬৪ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২১৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৬১টির এবং ২৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ২৬ কোটি ৭ লাখ টাকা।
সার্কিট ব্রেকারের নতুন নিয়ম শেয়ারবাজারের জন্য কেমন হবে জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করা ঠিক না। মার্কেট এক জায়গায় গিয়ে ঠিক হয়ে যেত। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আগের নিয়ম রাখা হয়েছে, কিন্তু কমার ক্ষেত্রে কমতে পারবে না, এটা আগের মতো আরও একটা ভুল সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, বিএসইসি সূচক নিয়ে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে কেন? তাদের উচিত বাজারে যে অনিয়ম হয় তা দেখা। সেইসঙ্গে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে বসে বিনিয়োগকারীদের সিস্টেমে কিছু প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা, তার ব্যবস্থা করা। এটার জন্য চেষ্টা, তদবির করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, দাম কমার ক্ষেত্রে সার্কিট ব্রেকারের যে নিয়ম করে দেওয়া হলো এটা বাজারের কোনো উপকার করবে না। ক্ষতিই করবে। বাজারে ফ্রি ডিমান্ড-সাপস্নাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। এত সমালোচনার পর ফ্লোরপ্রাইস উঠিয়েছে, তারপর আবার সেই দিকে যায়। ফ্লোরপ্রাইস পড়াটাকে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। যেটা পড়ার সেটা পড়বেই।