রাজধানীর রামপুরার ওয়াপদা রোড এলাকায় আধাপাকা টিনসেডের দুই রুমের বাসায় পরিবার নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে ভাড়ায় থাকেন মুদি দোকানী আকরাম হোসেন। গরমকালে বিদু্যতের প্রি-পেইড মিটারে এক হাজার টাকা লোড করলে পুরো এক মাস ভালোভাবেই চলে যেত। কিন্তু এবার ২০ দিন পার না হতেই ১২০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে।
একই অবস্থা তার প্রতিবেশী আব্দুল মালেকের। তিনি মাসের শুরুতে বিদু্যতের প্রি-পেইড মিটারে এক হাজার টাকা লোড করলেও এতে তিন সপ্তাহও চলেনি। ২০ এপ্রিল দুপুর থেকেই তার বিদু্যতের মিটারে সিগন্যাল দিতে শুরু করেছে। টানাটানির সংসারে বিদু্যৎ বিলের জন্য বাড়তি খরচ তার জন্য 'মরার ওপর খাড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু আকরাম হোসেন কিংবা আব্দুল মালেকেরই নয়, দীর্ঘদিন ধরে টানা তীব্র গরমে ধনী-গরিব, মধ্যবিত্ত সবারই বিদু্যতের খরচ ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চবিত্তদের কাছে বিষয়টি সহনীয় হলেও, নিম্ন-মধ্যবিত্তের পক্ষে এই চাপ সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অনেককে এ জন্য সংসারের অন্য বাজেট কাঁটছাঁট করতে হচ্ছে।
এদিকে টানা দাবদাহের কারণে শুধু বিদু্যতের খরচই বাড়েনি। এর সঙ্গে ওয়াসার পানির অতিরিক্ত বিল, অসুস্থতাজনিত খরচ, ফ্যান-কুলার-এসি মেরামত, সার্ভিসিং ও ক্রয় এবং ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর চালানোর জন্য ডিজেল কেনা বাবদ খরচও বেশখানিকটা বেড়েছে।
অন্যদিকে প্রচন্ড গরমে সবজির ক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে। তীব্র রোদের তাপে গাছের ফুল জালি ঝরে পড়ছে। গাছ ঝলসে যাচ্ছে। পটল, ঝিঙে, ঢেঁড়শ গাছ সব নেতিয়ে পড়ছে। সারাদেশে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি হওয়ায় গাছের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়। এতে ফলন কমে গেছে। জোগানের ঘাটতির কারণে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। তাই বাজারে
গিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তীব্র দাবদাহে স্বস্তি পেতে মধ্যবিত্তরা সঞ্চয় ভেঙে ফ্যান-কুলার ও এসি কিনছেন। কেউ কেউ এ ধরনের পুরনো ও অকেজো বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদি মেরামত করে কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন। প্রচন্ড গরমে ডায়েরিয়া, জ্বরের সঙ্গে বমি, টাইফয়েড, পাতলা পায়খানা হয়ে পানিশূন্যতা ও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ বাড়ায় মধ্যবিত্তরা সঞ্চয় ভেঙে চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছেন। এতে ব্যাংকের তারল্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, গরমের কারণে সাধারণ মানুষের- বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবন-যাপনের ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির ধারা উর্ধ্বমুখী থাকায় এই পরিস্থিতিতে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। আর সঞ্চয়ের মূল জোগানদাতা মধ্যবিত্ত শ্রেণি মানুষের ব্যয় যাওয়া মানেই হচ্ছে প্রকৃত সঞ্চয় কমে যাওয়া। এমনিতেই ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের মধ্যে আছে। আর যেহেতু এটা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে সঞ্চয় কমে যায়, তাহলে এটার প্রভাব নেতিবাচক হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতি বিশ্লেষক।
এদিকে চলমান দাবদাহে বিদু্যতের খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থনীতিবিদরা সরল চিত্রে তুলে ধরেছেন। তারা তীব্র গরম শুরুর আগে ও পরের বিদু্যতের চাহিদার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বাড়তি খরচের হিসাব মিলিয়ে দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা গত ২১ এপ্রিলের বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারের তথ্য তুলে ধরে জানান, গত ১৪ এপ্রিল দেশে বিদু্যতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। যা ১৫ এপ্রিল চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার মেগাওয়াটে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৫৪৩ মেগাওয়াট। ১৬ এপ্রিল বিদু্যতের চাহিদা দাঁড়ায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে। এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৮৯০ মেগাওয়াট। ১৭ এপ্রিল চাহিদা কিছুটা কমে ১৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে, ওই দিন উৎপাদন হয় ১৬ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। ১৮ এপ্রিল বিদু্যতের চাহিদা হয় ১৪ হাজার ৮১ মেগাওয়াট। ২০ এপ্রিল বিদু্যতের চাহিদা আবারও বেড়ে যায়। এদিন ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৩৫৮ মেগাওয়াট। এদিন চাহিদার তুলনায় বিদু্যৎ কম উৎপাদনের ফলে ১৪২ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হয়। ২১ এপ্রিল বিদু্যতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে। এই হিসাবে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিদু্যতের চাহিদা বেড়েছে তিন হাজার ৪০০ মেগাওয়াট অর্থাৎ ২৬.৫৬ শতাংশ। এতে গ্রাহকদের বিদু্যতের খরচও বেড়েছে একই হারে।
এদিকে তীব্র গরমের কারণে উচ্চবিত্তদের ঘরে ঘরে দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টা এসি চলার কারণে তাদের বিদু্যৎ খরচ মাত্রাতিরিক্ত হলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয়ের তুলনায় তাদের বাড়তি খরচের চাপ কম নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, বিদু্যতের বাড়তি খরচের চাপ উচ্চবিত্তের আয়ের তুলনায় ১ শতাংশ হলে নিম্ন-মধ্যবিত্তের আয় কম হওয়ার কারণে তাদের ওপর ওই চাপ ১০ থেকে নূ্যনতম ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে অসহনীয় গরমের কারণে অসুস্থতাজনিত খরচ যে কয়েকগুণ বেড়েছে, তা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর ভিড় পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে চলমান দাবদাহে গরমজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ২০-২৫ শতাংশ। তাদের একটি বড় অংশ শিশু হলেও শ্রমজীবী মধ্য বয়েসি রোগীর সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়াও নিম্নআয়ের বয়স্ক মানুষও ব্যাপক হারে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (শিশু হাসপাতাল), স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহ্?রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে এসব হাসপাতালে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত কয়েকদিনের গরমে শুধু ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই শতাধিক শিশু। মুগদা হাসপাতালের শিশু বিভাগেও ইতোমধ্যে রোগীতে সব শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও।
এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ নিম্নআয়ের মানুষের ঘর টিনের চালের হওয়ায় অধিক মাত্রায় উত্তপ্ত। সকালে সূর্য ওঠার পর থেকেই এসব আবাসস্থল গরম হতে শুরু করে। মধ্য দুপুরে প্রখর সূর্যতাপে তা অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে। যা গরমজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
গৃহপরিচারিকার কাজ করা যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সুলতানা পারভীন জানান, তার টিনের চাল ও টিনের বেড়ার ঘরে দুপুরে থাকা রীতিমতো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাই ছোট ছেলেমেয়েরা এ সময় ঘরের বাইরে আশপাশের গাছতলায় বসে থাকে। তবে চলাফেরায় অক্ষম বৃদ্ধ বাবাকে ঘরেই থাকতে হয়। তীব্র গরমে ও ঘরে থাকা বাসি খাবার খেয়ে ক'দিন আগে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে কয়েক মাসের সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে।
সুলতানা জানান, তাদের এলাকায় বিশুদ্ধ পানির ব্যাপক সংকট। দূর থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে হয়। আগে ছোট ছেলেমেয়েরা সেখান থেকে পানি নিয়ে আসলেও তীব্র গরমের কারণে তারা এ কাজ করতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে বোতলজাত পানি কিনতে হচ্ছে। এতে তার প্রতিদিন নূ্যনতম ৫০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। যা তার কাছে 'গোদের উপর বিষফোঁড়া' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে গরম বাড়ার কারণে মধ্যবিত্তের ওয়াসার পানির বিল বৃদ্ধির বিষয়টিও নানা পরিসংখ্যান চিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্য সময় বা শীতকালে রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা থাকে ২১০ কোটি লিটার থেকে ২২০ লিটার। যা বেড়ে কখনো কখনো ২৩০-২৪০ কোটি লিটারে গিয়ে ঠেকে। কিন্তু তীব্র গরম শুরুর পর তা বেড়ে ২৬০ লিটার ছাড়িয়ে গেছে। তাদের বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ২৯০ কোটি লিটার থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী, প্রতিদিন এখন গড়ে ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে ঢাকা ওয়াসা।
তবে ঢাকার বেশিরভাগ এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, গরম শুরুর পর থেকে তারা চাহিদা অনুযায়ী পানি পাচ্ছেন না। সরবরাহ লাইনে পানি না থাকায় দিনরাতের বেশিরভাগ সময় রিজার্ভার ট্যাঙ্কি খালি থাকে। তাই বাধ্য হয়ে অনেককে চড়া দামে ওয়াসা থেকে গাড়ির পানি কিনতে হচ্ছে।
সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা আশিকুল ইসলাম জানান, আগের মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি ওয়াসার পানির বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। এর ওপর লাইনে পানি না থাকায় গত দুই সপ্তাহে অন্তত পাঁচ গাড়ি পানি কিনতে হয়েছে। সবুজবাগ, মান্ডা, আহমেদবাগ, মুগদাসহ আশপাশের অধিকাংশ এলাকায় একই অবস্থা বলে অভিযোগ করেন তিনি।
একই এলাকা বাসিন্দা বসির উদ্দিন বলেন, এক গাড়ির পানির দাম ৬০০-৮০০ টাকা। কিন্তু এলাকায় পানির অতিরিক্ত চাহিদা থাকায় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তা সময়মত সরবরাহ করতে পারছে না। এই সুযোগে পানির গাড়ির লোকজন পানির দাম অতিরিক্ত ৫০০-৬০০ টাকা বেশি দাবি করছে। তীব্র গরমে পরিবারের লোকজন একাধিক গোসল না করলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই আশঙ্কায় অনেকে বেশি দাম দিয়ে হলেও পানি কিনছেন।
এদিকে তীব্র গরমে চাহিদার তুলনায় বিদু্যতের সরবরাহ না থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে যেসব বাসাবাড়িতে জেনারেটর রয়েছে, তাদের খরচ কতটা বেড়েছে, তা ঢাকার বেশ কয়েকটি ফুয়েল স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
রাজধানীর রামপুররা হাজীপাড়া ফিলিং স্টেশনের কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম জানান, জেনারেটরের জন্য ড্রামসহ বিভিন্ন কনটেইনার নিয়ে যারা ডিজেল বা পেট্রোল কিনতে আসেন, তাদের ভিড় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর ও বাড্ডাসহ আরও প্রায় এক ডজন ফুয়েল স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া গেছে।
বাড়ির মালিকরা জানান, সঞ্চালন লাইনের বিদু্যতের চেয়ে জেনারেটরে ডিজেল বা পেট্রোল পুড়িয়ে বিদু্যৎ পেতে হলে ২০-২৫ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খরচ পালস্না দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে।