দাবদাহে গলছে সড়কের বিটুমিন
মে'র প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৪ ডিগ্রি হিটস্ট্রোকে আরও চারজনের মৃতু্য জেলায় জেলায় বৃষ্টির আশায় নামাজ
প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
দেশজুড়ে প্রচন্ড তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। তৃতীয়বারের মতো ফের তিন দিনের সতর্কতা জারিসহ তাপপ্রবাহ মে মাসের ৪/৫ তারিখ পর্যন্ত চলতে পারে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে এ সময় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির ওপরে না ওঠা এবং বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা। প্রচন্ড দাবদাহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গলে যাচ্ছে সড়কের বিটুমিন। বৃহস্পতিবার শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের অন্তত ১৫টি স্থানে বিটুমিন গলে যায়। এর আগে যশোরে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে, প্রচন্ড গরমে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পুলিশের এক ইন্সপেক্টরসহ আরও চারজনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি অসহনীয় তাপপ্রবাহ থেকে মুক্তির আশায় বৃষ্টির জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামাজ পড়ে দোয়া করেছেন মুসলিস্নরা।
বৃহস্পতিবার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা বিভাগসহ দিনাজপুর, নীলফামারী, রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের বাকি অংশে যা অব্যাহত থাকতে পারে।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ ধরা হয়। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রির কম তাপমাত্রাকে বলা হয় মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির কম তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির ওপরে উঠলে তাকে বলা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।
আবহাওয়াবিদ আজিজুর রহমান বলেন, 'তাপমাত্রা আরেকটু বাড়ার সম্ভাবনা আছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দাবদাহ চলতে পারে। তবে অতি তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে হালকা বৃষ্টি সিলেট ও নেত্রকোনা এলাকায় হতে পারে, অন্য অঞ্চলে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২০ এপ্রিল; সেদিন যশোরে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।'
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহের এতটা ব্যাপ্তি আগে কখনো দেখেনি দেশ। এর আগে গত বছরও এপ্রিল
মাসে টানা ১৯ দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। কোথাও কোথাও তা অতি তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এ বছর সেটা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে।
হিটস্ট্রোকে আরও চারজনের মৃতু্য
প্রচন্ড গরমে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিটস্ট্রোকে মৃতু্যর খবর আসছে। যে কারণে জনগণকে সচেতন করতে সতর্ক থাকার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে।
সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নে কুট্টাপাড়া গ্রামের বাড়িতে হেলেনা বেগম (৭০) ও জমিতে ধান কাটার সময় নবি হোসেন (৫৫) নামে এক শ্রমিক মারা গেছেন। চিকিৎসকরা মনে করছেন, প্রচন্ড গরমে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তাদের মৃতু্য হতে পারে। নবি হোসেনের বাড়ি পানিরশ্বর ইউনিয়ন বেড়তলা গ্রামে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে দায়িত্ব পালনকালে রুহুল আমিন নামে এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের মৃতু্য হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন এসএম মাহমুদুর রশিদ জানান, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর রুহুল আমিনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নিয়ে আসার আগেই তার মৃতু্য হয়। হাসপাতালে যারা নিয়ে এসেছিলেন তারা বলেছেন তিনি তৃষ্ণার্ত ছিলেন, পানি খেতে চেয়েছিলেন। তবে তার মৃতু্য যে হিটস্ট্রোকে হয়েছে এটা নিশ্চিত করে এখনই বলা যাবে না। তবে এখন যেহেতু প্রচন্ড গরম চলছে তাই এটার প্রভাব থাকতেও পারে।
অন্যদিকে, রাজধানীর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের ফুটপাত থেকে এক রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বয়স আনুমানিক ৪৫ বছর। মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি অতিরিক্ত গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃতু্য হতে পারে। ময়নাতদন্তের পর মৃতু্যর সঠিক কারণ জানা যাবে।
যশোরে সর্বোচ্চ ৪২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস
আবহাওয়া অফিসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় যশোরে ৪২ দশমিক চার ডিগ্রি। এ সময় চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি।
গলছে সড়কের বিটুমিন
লাগাতার তীব্র তাপপ্রবাহে যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক, যশোর-খুলনা সড়ক, যশোর-নড়াইল সড়কের কিছু অংশের বিটুমিন গলে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে বিভিন্ন স্থানে বিটুমিন গলে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের বালিবাড়ির মোড় থেকে নরসিংহপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটারের অন্তত ১৫টি স্থানে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এদিকে বিটুমিন গলে যাওয়ায় সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে ধীরগতিতে যানবাহন চালাচ্ছেন চালকরা। এ ছাড়া পাথর সরে গিয়ে সড়ক দ্রম্নত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের শরীয়তপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে শরীয়তপুরে তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে রয়েছে। প্রচন্ড রোদে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সড়কে যানবাহন চলাচলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সড়কে বিটুমিন গলে যাওয়ার তথ্য তাদের কাছে নেই।
চাঁদপুর-শরীয়তপুর সড়কে নিয়মিত মাইক্রোবাস চালান দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, 'চাঁদপুর-শরীয়তপুর সড়কের অন্তত ১৫টি স্থানে বিটুমিন গলে যাচ্ছে। ওই স্থানে গাড়ির চাকা পড়লেই তা আটকে যাচ্ছে। সতর্কতার সঙ্গে ওই স্থানগুলো দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে।'
সওজের শরীয়তপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কের বিটুমিন গলে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সড়কে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয় যা ৪৯ থেকে ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সহনীয়। পাকা সড়কে বাতাসের তাপমাত্রার চেয়ে ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি ধরা হয়। বর্তমানে দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। এখন সড়কে ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হবে।
দীর্ঘমেয়াদি বিজ্ঞপ্তিতে বৃষ্টির আভাস
বৃহস্পতিবার দেওয়া ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকবে। বিরাজমান তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব বিরাজমান থাকতে পারে।
শনিবার সকাল থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব বিরাজমান থাকবে। বর্ধিত পাঁচ দিনের শেষের দিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
বৃষ্টির জন্য জেলায় জেলায় নামাজ ও দোয়া
টানা তাপপ্রবাহে সারাদেশে অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বৃষ্টির জন্য বিভিন্ন জায়গায় নামাজ পড়ে দোয়া করেছেন মুসলিস্নরা। চাঁদপুর, রাজশাহী, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ, সৈয়দপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা, মাদারীপুর, নাটোর, নেত্রকোনা, রাঙামাটি, ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল, শেরপুর, ভোলা এবং কুমিলস্নাসহ বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায় করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে এ নামাজ আদায় করা হয়। এতে অংশ নেন বিপুলসংখ্যক মানুষ।