বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ
ম্যালেরিয়া রোগী শূন্যে নামিয়ে আনা কঠিন
প্রকাশ | ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
পাঠান সোহাগ
দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত ও মিয়ানমারে অবাধ চলাচল; বান্দরবান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে আকস্মিক বন্যা এবং পার্বত্য জেলাগুলো দুর্গম এলাকায় বর্ষাকালে ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিয়মিত রেকর্ড সংরক্ষণ করতে না পারা ও সঠিক সময় মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস না করা- দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূলের পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদরা।
কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার যায়যায়দিনকে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়ার রোগী শূন্যে নামিয়ে আনা খুবই কঠিন। কারণ আমাদের দেশে যে অঞ্চলে এ মশা বংশবিস্তার করে সে জায়গাতে পৌঁছানো খুবই কঠিন। যেখানে মানুষই যেতে পারে না। সেখানে মশা ধ্বংস কঠিন কাজ। এ মশা নির্মূল করতে না পারলে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা যাবে না।
কীটতত্ত্ববিদ ডা. মুশফিকুর রহমান বিটু যায়যায়দিনকে বলেন, দেশের বর্ডার অতিক্রম করে অবৈধভাবে আসা-যাওয়ায় ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। পার্বত্য অঞ্চলে ১৪টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস। এদের মধ্যে মুরং উপজাতি বান্দরবানের লামা, আলীতকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় বসবাস করে। এরাই বেশি ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হচ্ছে।
এ বাস্তবতায় বিশ্বের ন্যায় সারাদেশে আজ (বৃহস্পতিবার) বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, 'ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করি, বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ি'।
এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া মুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে দেশ-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ বছরের শেষের দিকে শেরপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও কুডিগ্রাম জেলাকে ম্যালেরিয়া মুক্ত ঘোষণা করা হবে। পাশাপাশি ২০২৬ সালে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ম্যালেরিয়া মুক্ত ঘোষণার পরিকল্পনা চলছে। এমনকি ২০২৭ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা পার্বত্য অঞ্চলের জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগী প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ১-এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ নিয়ে আবেদন করবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (হু) কাছে। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০৩৩ সালে হু ম্যালেরিয়া মুক্ত ঘোষণা করবে এই অপেক্ষায় রয়েছে দেশ।
কীটতত্ত্ববিদ ডা. মুশফিকুর রহমান বিটু বলেন, মিয়ানমারের ম্যালেরিয়া রোগী আছে। নেপাল ও ভারতে ম্যালেরিয়া অনেক। মিয়ানমারের মশা এন্টি রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। এ মশা যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে আর মানুষকে আক্রান্ত করে তাহলে আমাদের এ ওষুধ আর কাজ করবে না। তখন আমরাও বিপদে পড়ব। বর্তমানে আমাদের মশারি ও খাবার ওষুধ খুবই কার্যকরী। আমাদের সাফল্যও আসছে।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা পার্বত্য অঞ্চলের ১৩ জেলায় যখন মশা নিয়ে কাজ করেছি, তখন ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা পেয়েছি। এদের মধ্যে প্রিন্সিপাল ফ্যাক্টর ৪ প্রজাতি ও সেকেন্ডারি ফ্যাক্টর ৩ প্রজাতির। এই সাতটি প্রজাতির মশা ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে প্রধান চারটি প্রজাতির স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া প্রধান বাহক। বর্তমানে ঢাকাতেও অ্যানোফিলিস মশার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। দেশের যেসব অঞ্চলে পাহাড়-বন-জঙ্গল আছে, সেসব অঞ্চলে এ মশা বেশি বংশ বৃদ্ধি করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্যমতে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ লাখ ১৯ হাজার ৫৬১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ১৫৮ ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। পাশাপাশি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ২ জন মারা গেছেন। ২০২৩ সালে মোট পরীক্ষা হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৪৭০ জন। এদের মধ্যে ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৫৬৭ জন। এরং মারা গেছে ৬ জন। এর আগের বছর ২০২২ সালে মোট পরীক্ষা হয়েছে ১৫ লাখ ৭৮ হাজার ৪৪৯ জন। এদের মধ্যে ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়েছে ১৮ হাজার ১৯৫ জন। সে বছর মারা গেছে ১৪ জন। এ ছাড়া ২০২১ সালে মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৮৪৯ জন। এদের মধ্যে ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ২৯৪ জন। এরং মারা গেছেন ৯ জন। এরও আগের বছর ২০২০ সালে মোট ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ১৩০ জন। সে বছর মারা গেছেন ৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়ায় মোট ১৬ হাজার ৫৬৭ জন রোগী শনাক্ত হয়। এর মধ্যে বান্দরবান জেলায় ৬০ দশমিক ৩৭ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ, কক্সবাজারে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ৮ জেলায় শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগের বছর ২০২২ সালে ম্যালেরিয়ায় বান্দরবান জেলায় ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ, রাঙ্গামাটিতে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, কক্সবাজারে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ৮ জেলায় শূন্য দশমিক ১ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে প্রবাস থেকে ফিরে ৭৩৭ জন ম্যালেরিয়ায় অক্রান্ত হয়। এদের সবাই বিদেশফেরত। এদের মধ্যে ভারতের মেঘালয় ও মিজোরাম ভ্রমণ করে সবচেয়ে বেশি রাঙ্গামাটি এসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ওমান, দুবাই, সৌদি আরব, মোজাম্বিক, সাউথ আফ্রিকা ও ঘানা থকে প্রবাস ফেরত অনেকই দেশে ফিরেছেন। তারা দেশের কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলায় আদি বাসিন্দা। দেশে ফেরার পর তাদের ম্যালেরিয়া রোগ শনাক্ত হয়। এর আগের বছর ২০২২ সালে ১৫৯ জন বিদেশ ফেরত প্রবাসীর ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়।
কীটতত্ত্ববিদ ডা. মুশফিকুর রহমান বিটু বলেন, দেশের মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশই তিন পার্বত্য জেলায়। বাকি রোগী অন্য জেলার। তবে চট্টগ্রাম বিভাগের বাহিরে যেসব রোগী আমরা পাচ্ছি, তাদের ভ্রমণের ইতিহাস আছে। ম্যালেরিয়া শনাক্ত হওয়ার কিছুদিন আগে তাদের পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণ করেছে। উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন আমরা অনেক ম্যালেরিয়া রোগী পাচ্ছি।