শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

সহযোগীসহ পর্নোগ্রাফার টিপু দুই দিনের পুলিশি রিমান্ডে

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
পর্নোগ্রাফি তৈরির অভিযোগে শিশুসাহিত্যিক টিআইএম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া ও তার প্রধান সহযোগী কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয় -সংগৃহীত

পাঁচশ' থেকে হাজার টাকার লোভে ফেলে ছেলে পথশিশুদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করা হতো। এসব শিশুর মধ্যে ২৫-৩০ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। শিশুদের দিয়ে তৈরি করা পর্নোগ্রাফির ভিডিও বিক্রি করা হতো বিকৃত যৌনচারে আনন্দ পাওয়া বিদেশিদের কাছে। সাহিত্য চর্চার আড়ালে এমন পর্নোগ্রাফি তৈরি করতেন পর্নোগ্রাফার টিআইএম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া ও তার প্রধান সহযোগী কামরুল ইসলাম। তাদের দুই দিনের পুলিশি রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে।

এডিসি আহমেদুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, আসামিদের সাত দিন করে রিমান্ড চেয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত আসামিদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে।

বুধবার দুপুর ১২টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এসব তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, গত ২৩ এপ্রিল রাতে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের সূত্র ধরে ঢাকার খিলগাঁও থানাধীন একটি বাড়িতে অভিযান চালায় অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আহমেদুল ইসলামের নেতৃত্বে সিটিটিসির

\হস্পেশাল অ্যাকশন গ্রম্নপের এন্টি ইললিগ্যাল আর্মস রিকভারি টিম।

অভিযানে গ্রেপ্তার হয় আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফির মূলহোতা টিআইএম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া (৫৭) ও তার সহযোগী কামরুল ইসলাম ওরফে সাগর (২০)। তাদের কাছে পাওয়া গেছে বিপুল পর্নোগ্রাফি ও পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম। বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ১২ বছর বয়সি এক ছেলেশিশুকে। যাকে দিয়ে পর্নোগ্রাফির ভিডিও তৈরির চেষ্টা চলছিল।

ডিআইজি আসাদুজ্জামান জানান, জব্দ করা পর্নোগ্রাফির মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ২৫ হাজার ছবি গণনা করা সম্ভব হয়েছে। পুরোপুরি গণনা করতে আরও সময় লাগবে। জব্দ হওয়া ছবি গণনা করা হলে কমপক্ষে লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বুধবার দুপুর পর্যন্ত এক হাজার ভিডিও গণনা করা সম্ভব হয়েছে। জব্দ হওয়া কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আরও হাজার হাজার ভিডিও এবং কনটেন্ট পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জব্দ হওয়া কনটেন্ট ও ভিডিও পুরুষ শিশুদের দিয়ে করানো। এতে কোনো নারী ব্যবহৃত হয়নি। ভিডিওগুলো আকর্ষণীয় করতে বাসাবাড়ি ছাড়াও বন-জঙ্গলেও ধারণ করা হয়েছে। ভিডিওতে অংশ নেওয়া শিশুদের অধিকাংশই ঢাকার গুলিস্তান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কমলাপুর রেলস্টশনসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার ছিন্নমূল শিশু। তাদের পাঁচশ' থেকে হাজার টাকার লোভে ফেলে বাসাবাড়িতে নিয়ে পর্নোগ্রাফির ভিডিও তৈরি করা হতো। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা যাতে ভিডিও পছন্দ করে, ঠিক সেভাবে স্থান নির্বাচন করে ভিডিও তৈরি করা হতো। ধারণ করা ভিডিও এডিটিং করতেন কিবরিয়া নিজেই। তার বাসাতেই ভিডিও এডিটিং প্যানেল আছে। তার পর্নোগ্রাফিতে অংশ নেওয়া শিশুদের কারও বয়সই ১২ বছরের বেশি নয়।

ডিআইজি আসাদুজ্জামান জানান, কিবরিয়া এক সময়কার খুব জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৭ সালে বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৮৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯১ সালে সেবা প্রকাশনীর মাসিক কিশোর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনে তিনি ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রি হিসেবে কাজ শুরু করেন। বহু শিশু-সাহিত্য রচনা করেছেন। যার মধ্যে অর্ধশতাধিক শিশু সাহিত্যের বই প্রকাশিত হয়েছে সেবা প্রকাশনী থেকে।

পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০০৫ সাল থেকে তিনি শিশু সাহিত্য চর্চার আড়ালে শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি করা শুরু করেন। পরে তা বিকৃত যৌনাচারে আনন্দ পাওয়া বিদেশি ব্যক্তিদের কাছে গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতেন। পাঠিয়ে দেওয়ার পর তিনি ব্যক্তিগতভাবে ওইসব বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে মানিগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ নিতেন। অনেক বিদেশি গ্রাহক তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও ভিডিও কিনে নিতেন। ক্রেতাদের অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও কানাডার নাগরিক। যারা মূলত বিকৃত যৌনচারে আনন্দ পান। তিনি মাত্র তিনটি কনটেন্ট বিক্রি করে এক হাজার ডলার নিয়েছেন বিদেশিদের কাছ থেকে। গ্রেপ্তার কামরুল ইসলাম কিবরিয়ার এজেন্ট। তিনি বিদেশি গ্রাহকদের ভিডিওসহ নানা কনটেন্ট পাঠানোর কাজের পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহ করতেন।

দৈনিক যায়যায়দিনের এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, এখন পর্যন্ত ২৫৩০ জন শিশু ভিকটিমকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের পরিচয়ও পাওয়া গেছে। শিশু পর্নোগ্রাফিসহ আপত্তিকর কনটেন্ট বন্ধে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) ও সিটিটিসির পদক্ষেপের বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আদের সাইবার ইউনিট প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সাইট মনিটরিং করছে। যেসব আপত্তিকর কনটেন্ট বা সাইট আমাদের নজরে আসে, ওইসব সাইট ও কনটেন্ট বন্ধ করতে বিটিআরসিকে প্রস্তাব করা হয়। এমন প্রস্তাব প্রতিনিয়ত দেওয়া হচ্ছে। অনেক সাইট বা কনটেন্ট বন্ধও করা সম্ভব হচ্ছে। তারপরও ফাঁক-ফোকর থাকায় অনেক সাইট বা কনটেন্ট বন্ধ করা সম্ভব হয় না। আবার অনেক কনটেন্ট ও সাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলো বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও সিটিটিসি ও বিটিআরসি আপত্তিকর সাইট ও কনটেন্ট বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে।

সিটিটিসি প্রধান আরও জানান, শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরির ঘটনায় বিশ্বের অনেক দেশে আলোচনায় এসেছিলেন টিপু কিবরিয়া। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ইতোপূর্বে বিষয়টির গভীর তদন্ত করে। তদন্তে দোষ প্রমাণিত হওয়ায় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও ইন্টারপোলের সহায়তায় ২০১৪ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) টিপু কিবরিয়াকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় ৭ বছর জেল খেটে তিনি ২০২১ সালে কারাগার থেকে বের হন। মু্ি‌ক্তর পর তিনি শিশু-সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 'একশ এক' নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, কারামুক্ত হলেও নিজেকে অপরাধ থেকে মুক্ত করতে পারেননি টিপু কিবরিয়া। ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনেও। তিনি একজন বিকৃত রুচির মানুষ। যে কারণে তিনি আবারও জড়িয়ে পড়েন শিশু পর্নোগ্রাফিতে। আবারও তিনি সাহিত্য চর্চার আড়ালে শিশু পর্নোগ্রাফির সেই পুরনো পথেই হাঁটতে থাকেন। তার তৈরি করা পর্নোগ্রাফির ক্রেতাদের অধিকাংশই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত এবং বিকৃত রুচির মানুষ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে