আরও ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট
দাবদাহে ত্রাহি অবস্থা জনজীবনে
সর্বোচ্চ ৪১.২ ডিগ্রি চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় ৫ দিনে হিটস্ট্রোকে মৃতু্য ৩৫ হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ
প্রকাশ | ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
বৈশাখের শুরু থেকেই টানা তাপপ্রবাহে দেশের জনজীবন ওষ্ঠাগত। এর মাঝে তাপপ্রবাহ নিয়ে ফের দুঃসংবাদ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বুধবার দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের অধিকাংশ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহের বিস্তার হতে পারে। সিলেট বিভাগে বৃষ্টির আভাস রয়েছে। আর রংপুর বিভাগের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে। এদিকে, প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে এদিন বরগুনার তালতলীর এক শ্রমিক এবং কুড়িগ্রামের চিলমারীর সত্তরোর্ধ এক বৃদ্ধের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, হিটস্ট্রোকে তাদের মৃতু্য হতে পারে। এদের নিয়ে গত ২০ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দিনে সারাদেশে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পুলিশসহ মারা গেছেন অন্তত ৩৫ জন। তীব্র গরমে সারাদেশের হাসপাতালে বাড়ছে নানা বয়সি রোগী। এদের মধ্যে পানি শূন্যতায় আক্রান্ত রোগী সর্বাধিক।
বুধবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় দিন দিন তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে ঢাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি, ২০২৪ সালে এসে তা হয়েছে ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বুধবার সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার থেকে আরও তিনদিনের হিট অ্যালার্ট জারি করা হবে।
তিনি আরও জানান, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এদিকে রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর ও পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, চাঁদপুর, বান্দরবান জেলাসহ ঢাকা, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগ এবং রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল
\হবিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা বিস্তার লাভ করতে পারে।
আজ সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগের দুই/এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
তিনি বলেন, 'সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পাবে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পাবে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বিরাজ করতে পারে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়বে।'
শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগের দুই/এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকবে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়বে। বর্ধিত পাঁচদিনে আবহাওয়ার উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলেও তিনি উলেস্নখ করেন।
৫ দিনে হিটস্ট্রোকে ৩৫ জনের মৃতু্য
অন্যদিকে, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দিনে সারাদেশে পুলিশসহ অন্তত ৩৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে বরগুনার তালতলীতে এক শ্রমিক এবং কুড়িগ্রামে চিলমারীতে এক বৃদ্ধের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে।
তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, পুকুর খননকালে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে নয়া মিয়া ফকির (৫০) নামে এক শ্রমিকের মৃতু্য হয়েছে। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের খোট্টার চর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত শ্রমিক একই গ্রামের আমির আলী ফকিরের ছেলে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হাসান মিয়ার বাড়িতে পুকুর খনন করার সময় নয়া মিয়া ফকির অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুমন কুমার পোদ্দার বলেন, 'হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তার মৃতু্য হয়। তীব্র গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃতু্য হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।'
এছাড়া কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় রমনা ইউনিয়নের রমনা বেপারীপাড়া গ্রামে অসুস্থ হয়ে নজির হোসেন নামে ৭০ বছর বয়সি একজনের মৃতু্য হয়েছে। বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তিনি মারা যান।
ওই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রোকনুজ্জামান সরকার জানান, নজির হোসেনের বসতভিটা চিলমারী নৌ-বন্দর সম্প্রসারণ কাজে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণ করা হবে। এ নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। এ ছাড়া সকাল থেকে প্রচন্ড দাবদাহের কারণে তিনি বারবার পানি খাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মারা যান। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তার মৃতু্য হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাবনা ও চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি
টানা ছয়দিন ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বুধবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকাল ৩টায় চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস এ তাপমাত্রা রেকর্ড করে। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার দুপুর তিনটায় বাতাসের আর্দ্রতা ২১ শতাংশ পরিমাপ করে। এই চলমান তাপপ্রবাহে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় জেলাজুড়ে অনুভূত হচ্ছে 'মরুর উষ্ণতা'।
গত ১৬ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ছয় দিন জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি ছিল। গত শনিবার বেলা ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এটি চুয়াডাঙ্গায় এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। জেলায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তীব্রতাও বেড়েছে। এতে দুর্বিষহ হয়ে পড়ে এখানকার জনজীবন। গত বছরের ১৯ ও ২০ এপ্রিল মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অতি তীব্র দাবদাহ। কাছাকাছি সময়ে বৃষ্টি না হলে গত বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে যেতে পারে।
মঙ্গলবার মাঝরাতে ঝড়োহাওয়ার সঙ্গে জেলায় প্রায় ২০ মিনিট বৃষ্টিপাত হলেও জনজীবনে তেমন স্বস্তি আসেনি। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি আরও বেড়েছে। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার জেলায় ১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এ সময় ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার বেগে ঝড়োহাওয়া রেকর্ড করা হয়।
হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ
পাবনা প্রতিনিধি জানান, প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। গত কয়েকদিনের টানা তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘরের বাইরে গরম বাতাসে এ যেন আগুনের উড়ো তাপ এসে বিদ্ধ করছে সারাশরীর। কোথায়ও মিলছে না এক পশলা স্বস্তির শ্বাস।
তীব্র তাপপ্রবাহ হাসপাতালে শিশু-বৃদ্ধসহ নানা বয়সি রোগী ভর্তি বাড়ছে। এর বেশিরভাগই ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। ইতোমধ্যে তীব্র গরমে দুইজনের প্রাণহানিও ঘটেছে।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শয্যা না পেয়ে অনেকে মেঝেতে, বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোগীর এত চাপ যে মানুষের গরমও আরেক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৪ জন। এর মধ্যে শিশু ৩৫ জন, পুরুষ ২ জন ও মহিলা ৭ জন। বর্তমানে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৬৯ জন।
ঈশ্বরদী আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়া পর্যবেক্ষক নাজমুল হক জানান, বুধবার বিকাল ৩টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
প্রতিদিন সড়কে ৪ লাখ লিটার পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি
দেশজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে মানুষ। রাজধানীর প্রতিটি সড়ক যেন অগ্নিকুন্ড। এদিকে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) করা ২০১৭ ও ২০২৪ সালের ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রার তারতম্যের মূল্যায়ন সম্পর্কিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছে মহাখালী ও গুলিস্তানে। এমন অবস্থায় তাপ কমাতে প্রতিদিন সড়কে পানি ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ৫ ঘণ্টা পানি ছিটানো হচ্ছে। পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে দুটি স্প্রে ক্যানন এবং ১০টি ব্রাউজার। এতে করে দৈনিক প্রায় চার লাখ লিটার পানি ছিটানো সম্ভব হয়।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের নির্দেশে ছুটির দিনগুলোতেও পানি ছিটানো অব্যাহত থাকবে। গরমের দিন ছাড়াও শীতের দিনেও সড়কের ধুলাবালি ও বায়ুদূষণ রোধে এসব মেশিন দিয়ে পানি ছিটানো হয়ে থাকে।