কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অপসারিত চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান বলেছেন, 'চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায় এড়াতে পারেন না। তবে ঘটনাটি তার নজরে আসেনি। বিষয়টি তিনি বুঝতেই পারেননি। তার স্ত্রী অনেকটাই বিনা দোষে কারাগারে রয়েছেন বলে তার ধারণা। স্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও তার অজানা বলে দাবি করেন তিনি।
তবে ডিবিপ্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলছেন, 'চেয়ারম্যান কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না এবং পারবেন না। পুরোপুরি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সনদ বাণিজ্য হয়েছে। এসব ভুয়া সনদের ক্রেতা হিসেবে শিক্ষকসহ অন্যদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই সনদ বাণিজ্যের ঘটনায় গ্রেপ্তার ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
দিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্যের মূল উৎপাটন করা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা
গেছে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অপসারিত চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানকে মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ডিবি কার্যালয়ে একটানা ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিন ঘণ্টা পর খানিকটা বিরতি দেওয়া হয়। এ সময় চেয়ারম্যান ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ সেল থেকে বের হয়ে নিচে নামলে সাংবাদিকরা তার প্রতিক্রিয়া জানতে চান।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, 'চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সনদ বাণিজ্য বা যে অভিযোগ এসেছে বা যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দায়েরকৃত মামলার তদন্ত চলছে, আমি তা অস্বীকার করতে পারি না বা দায় এড়াতে পারি না। এমনকি দায় এড়ানোর কোনো সুযোগও নেই।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বলছি, 'পুরো ঘটনাটিই ঘটেছে আমার অগোচরে। আমি বিষয়টি বুঝতে পারিনি। এমনকি আমি নূ্যনতম ঘটনার বিষয়ে আঁচ করতে পারিনি। বুঝতে পারলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতাম।'
তার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সনদ বাণিজ্য বাবদ ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমি কোনো ঘুষ নেইনি'।
তার স্ত্রীর জড়িত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমার স্ত্রী কীভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, সেটি আমার অজানা। এ ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। এমনকি স্ত্রী আমার সঙ্গে বিষয়টি শেয়ারও করেনি। আমার স্ত্রী নির্দোষ বলে আমি মনে করি। এমনকি তিনি বিনা দোষে জেলে রয়েছেন বলেও আমার বিশ্বাস। তবে আমার স্ত্রী যদি সত্যিই অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকে এবং এমন জাল সনদ বাণিজ্যে জড়িত থাকে, তাহলে অবশ্যই তিনি আইন মোতাবেক সাজাপ্রাপ্ত হবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই'।
এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, 'বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পেরেছি, বোর্ড থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সনদপত্র বিক্রি হয়েছে। এর বাইরে আরও কোনো সনদপত্র বিক্রি হয়েছে কিনা, সে বিষয়টি আমার অজানা। বিক্রিত সনদের বিষয়ে তদন্ত মোতাবেক সরকার বা সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে'।
সিস্টেম এনালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান কেন বাসায় সনদপত্র কারখানা স্থাপন করেছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'লোকবল কম থাকায় তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়েছেন। তবে তিনি যে বাসায় বসে সনদ তৈরি করছিলেন, এটি আমার জানা ছিল না'। এরপর তিনি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে আবারও ডিবি কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশ করেন।
খানিকটা পর ডিবি কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, টানা তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে অপসারণকৃত চেয়াম্যানকে। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে সব তথ্যই এই মুহূর্তে তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না'।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, 'চেয়ারম্যান নিজেই এর দায় এড়াতে পারেন না বলে স্বীকার করেছেন আমাদের কাছে। তিনি যে দায় এড়াতে পারবেন না, সেটি আমাদের তদন্তেও এসেছে। কারিগরি শিক্ষার মতো একটি সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের জালিয়াতি একটি জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট'।
ডিবিপ্রধান বলেন, 'চেয়ারম্যান যতই বলুক, তিনি বিষয়টি জানেন না, সেটি আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এমনকি বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোনো সুযোগও নেই। কারণ, তার দোষ প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে'।
তবে কৌশলগত কারণে চেয়ারম্যানকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। এটি এক ধরনের কৌশল বলা চলে। তদন্ত চলছে। তদন্তের একপর্যায়ে তাকে গ্রেপ্তার দোখানো হতে পারে বা গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তদন্ত চলাকালীন সময় তার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। মোটামুটি বলতে গেলে তিনি ডিবির গোয়েন্দা জালের মধ্যেই আছেন। বের হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। যদিও তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করছে। আরও তথ্য পেতে চেয়ারম্যানকে ২-১ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। মূলত এই সময়টিতে তাকে ওয়াচ করা হবে। তার নেটওয়ার্ক ও দোষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেই এমন কৌশল।
ডিআইজি হারুন-অর-রশীদ বলছেন, 'পুরোপুরি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সনদ বাণিজ্য হয়েছে। সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে ছয়জনকে ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে পাঁচজনই আদালতে বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় নিজেদের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে সারাদেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেরই নাম এসেছে। তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তাদেরও পর্যায়ক্রমে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।'
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, 'যেখানে সনদপত্র বোর্ডে তৈরি হওয়ার কথা, সেখানে সনদ তৈরি হচ্ছিল ঢাকার শেওড়াপাড়ার একটি বাসায়। যেটি অবিশ্বাস্য। এসব সনদ তৈরি করে বিক্রি করার পর তা অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে দেওয়ার জন্য যে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি সাধারণত চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকার কথা। কোনো সনদ জাল কিনা, সেটি দেখার একমাত্র উপায় হচ্ছে অনলাইনে সার্চ করা। অথচ অনলাইন বলছে, ওইসব সনদ আসল'। সত্যিকার অর্থে এসব সনদ জাল হলেও অনলাইনে বিশেষ কৌশলে সই করে আপলোড করার কারণে সেগুলো আসল হয়ে গেছে'।
তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া কোন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে, কত শিক্ষার্থী পাস করেছে এবং পাসের বিপরীতে কতটি সনদ সই করা হলো, সেটি দেখার দায়িত্ব চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের। অবশ্যই উচিত ছিল, নম্বরপত্র দেখে সার্টিফিকেট ইসু্য করা। সেটি করা হয়নি। যার স্পষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে'।
এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অনেক কম মেধাবী বা ফেল করার মতো শিক্ষার্থীও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভালো ফলাফল করেছে। অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীরা মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ভালো পড়াশোনা করছে। আর সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে তেমনই মেধাবী শিক্ষার্থীদের মতো ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ও ফেল করার মতো শিক্ষার্থীরাও। এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। কারণ, একই ধরনের ফলাফল নিয়ে তারা চাকরিতে প্রতিযোগিতা করছেন। ফলে প্রতিযোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই বেড়ে যাচ্ছে। যেটি সত্যিকার অর্থে সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তাই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্যের মূল উৎপাটন করতে প্রয়োজনে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে'।
প্রসঙ্গত, সনদ জালিয়াতি-সংক্রান্ত ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অপসারণকৃত চেয়ারম্যানের স্ত্রীকে গত ২০ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পরদিন ২১ এপ্রিল তাকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডের আবেদন করলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মঙ্গলবার বিকালে দুই দিনের রিমান্ড শেষে আসামিকে ঢাকার আদালতে সোপর্দৃ করেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির লালবাগ বিভাগের পরিদর্শক মো. আমিরুল ইসলাম। তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রহমান জামিন চেয়ে আবেদন করেন। আবেদন নামঞ্জুর করে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউলস্নাহর আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। একই সঙ্গে বুধবার শুনানির দিন ধার্য করেন বিচারক।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডিবির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, চেয়ারম্যানের স্ত্রীকে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এ জন্য তাকে আদালতে পাঠিয়ে নতুন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়নি। তবে প্রয়োজন হলে আবারও রিমান্ডের আবেদন করা হবে।
উলেস্নখ্য, গত ১ এপ্রিল কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্যের দায়ে গ্রেপ্তার হয় সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী এ কে এম শামসুজ্জামান। তার দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ওঠে এসেছে অনেকের নাম। তাদের গ্রেপ্তারে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে ডিবি পুলিশ।