হিটস্ট্রোকে দুইজনের মৃতু্য
সারাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত
ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা বৃষ্টির আশায় এস্তেস্কার নামাজ আদায়
প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
টানা এক সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। জারি রয়েছে সতর্কতা। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের প্রায় সব জেলার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপর। রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের অবস্থাও প্রায় কাছাকাছি। আগামী তিন দিনেও এ পরিস্থিতি থেকে উন্নতির কোনো পূর্বাভাস নেই। বরং তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে তুলনামূলক স্বস্তিতে আছে সিলেট বিভাগ। এ ছাড়া ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রংপুরে তাপপ্রবাহ অন্য বিভাগের চেয়ে কিছুটা হলেও সহনীয়। মঙ্গলবার সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এদিকে, প্রচন্ড গরমে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকা ও জামালপুরে দুইজনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। আর বৃষ্টির আশায় ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় এস্তেস্কার নামাজ আদায় করেছেন মুসলিস্নরা। আর হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অন্যদিকে, পরপর দুই দিন তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর মঙ্গলবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আবার বেড়েছে। আজ আরও বাড়তে পারে। গত শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ওইদিনই রাজধানীর তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি। এরপর দুদিন তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি কমে যায়। মঙ্গলবার নগরীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে গরমের অনুভূতি ছিল ৪০ ডিগ্রির মতো। এদিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক দিন জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে জনজীবনে অস্বস্তি বিরাজ করতে পারে। লঘুচাপের বাড়তি অংশ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করছে। এজন্য সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আগামী ৪৮ ঘণ্টার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
তাপপ্রবাহের বিষয়ে বলা হয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার ও রাঙামাটি জেলাসহ ঢাকা, রংপুর ও বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
হিটস্ট্রোকে দুইজনের মৃতু্য : এদিকে প্রচন্ড গরমে মঙ্গলবার সকালে
\হরাজধানীর গুলিস্তানের রাস্তায় এবং জামালপুরে বাড়িতে এক ব্যবসায়ী হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, এদিন সকাল ১০টায় আলমগীর শিকদার নামে এক ব্যক্তি বাসে করে হানিফ ফ্লাইওভার ব্রিজ দিয়ে গুলিস্তান নামেন। সেখান থেকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। দেখতে পেয়ে লোকজন প্রথমে তার মাথায় পানি দেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে দ্রম্নত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরপরই চিকিৎসক তাকে মৃত বলে জানান। ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়া পথচারী আনোয়ার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
খবর পেয়ে ঘটনাটি তদন্তে হাসপাতালে আসেন ওয়ারী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহ আলম। তিনি জানান, দুই পথচারী ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তাদের মাধ্যমে ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা জানা গেছে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃতু্য হয়েছে। তার পকেটে থাকা এনআইডি কার্ড ও বিভিন্ন ফোন নম্বরের সূত্র ধরে তার নাম-পরিচয় জানা গেছে। পরে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
নিহতের বন্ধু আব্বাস মোলস্না জানান, আলমগীর পরিবার নিয়ে যাত্রাবাড়ী কাজলা পেট্রোল পাম্পের পেছনে থাকতেন। মিরপুরে একটি ছাপাখানায় চাকরি করতেন তিনি। সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন মিরপুরে যাওয়ার জন্য। পরে ফোনের মাধ্যমে তার মৃতু্যর খবর শুনতে পান তারা।
অন্যদিকে, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার গোলাম রাব্বানী নামে এক ব্যবসায়ী বেলা ১১টায় নিজের বাড়িতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স নেওয়ার পথে তার মৃতু্য হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা মৃতু্যর বিষয় নিশ্চিত করেন।
ইসলামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের কর্মকর্তা এএএম আবু তাহের বলেন, 'আমরা ধারণা করছি অতিরিক্ত গরমের কারণে গোলাম রাব্বানীর মৃতু্য হয়েছে।'
খুলনা অফিস থেকে আতিয়ার রহমান শান্ত জানান, তীব্র দাবদাহে পুড়ছে খুলনা বিভাগ। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বের হলেই গরম বাতাস শরীরে জ্বালা ধরাচ্ছে। তীব্র দাবদাহে নাকাল হয়ে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। জীবিকার তাগিদে এমন খরতাপেও ঘর থেকে বাইরে বের হতে হচ্ছে তাদের। তবে জরুরি প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
ময়লাপোতা মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা ইজিবাইক চালক আরিফুল ইসলাম বলেন, 'প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হয়। নিত্যপণ্যের যে দাম, তাতে আর বিশ্রাম নেওয়ার কথা মাথায় আসে না। সারাদিনের কষ্ট শেষে ঘরে ফিরে পরিবারের হাসিমুখ দেখলে তৃপ্তি মেলে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'প্রচন্ড গরমে গলা শুকিয়ে আসে। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মাঝেমধ্যে পানি পান করি। তারপরও মনে হয় তৃষ্ণা মিটছে না। গরম বাতাস আর সূর্যের তাপে শরীরে জ্বালাপোড়া করে।'
নগরীর শিববাড়ী এলাকার সবজি বিক্রেতা তালেব মিয়া বলেন, 'প্রায় ৫০ বছর ধরে সবজি বিক্রি করে খাই। স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে আমার পরিবার। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। মেয়েটা অনার্সে পড়ে। এখন তিনজনের সংসার আর মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে আমাকে কাজ করতে হয়। রোদে বসে, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করি। এখন সব সয়ে গেছে, তাপমাত্রা বুঝি না।'
যশোরে ভ্যানে করে ভাঙাড়ি কুড়িয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেকেন্দার মোলস্না। তিনি বলেন, 'ঘর থেকে বের না হয়ে উপায় কী! যত গরম হোক, পেট তো মানবে না। বাড়িতে বউ-বাচ্চা আছে। বাড়ি বসে থাকলে তো কেউ দু-মুঠো চাল আগায় দেবে না। বের হয়েছি, রোদে রোদে ঘুরে মাল টোকাচ্ছি।'
চুয়াডাঙ্গার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, এপ্রিল মাসজুড়ে দাবদাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চার নির্দেশনা
সারাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহে সবারই হাঁসফাঁস অবস্থা। এর ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে অস্বস্তি, তেমনি বাড়ছে হিটস্ট্রোক বা সান স্ট্রোকের ঝুঁকি। এ অবস্থা থেকে সহসাই যে মুক্তি মিলছে না সে কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বিদ্যমান আছে। এ অবস্থায় সুস্থ থাকতে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
নির্দেশনাগুলো হলো- তীব্র গরম থেকে দূরে থাকা এবং মাঝেমধ্যে ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়া; প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করা। হেপাটাইটিস এ, ই, ডায়রিয়াসহ প্রাণঘাতী পানিবাহী রোগ থেকে বাঁচতে রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলা এবং প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করা; গরম আবহাওয়ায় ঢিলেঢালা পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরিধান করা, সম্ভব হলে গাঢ় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলা। এ ছাড়া গরম আবহাওয়ায় যদি ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, বমি বমি ভাব দেখা দেয়, তীব্র মাথাব্যথা হয়, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে হাসপাতালে যেতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার দাবি
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু আহ্বান জানিয়েছেন, তীব্র গরমের কারণে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ফের বন্ধ না করে অনলাইনে শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এ আহ্বান জানান তিনি।
এতে বলা হয়, সারাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ায় এবং সরকার হিট অ্যালার্ট জারি করায় দেশের সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সাত দিনের জন্য বন্ধ করার দাবি জানায় অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। এ দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আবার কোথাও কোথাও অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বহমান থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও এক সপ্তাহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় এবং হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা পেতে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দিচ্ছি।
অনলাইনে শ্রেণির কার্যক্রম পরিচালনায় বন্ধের সময়ের শিক্ষার ঘাটতি পূরণে অনেকটাই সহায়তা হবে বলে মনে করেন তিনি।
বৃষ্টির আশায় ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় নামাজ
এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে বৃষ্টি কামনায় মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আফতাবনগর ঈদগাহ মাঠে এবং চুয়াডাঙ্গা শহরের টাউন ফুটবল মাঠে ইস্তিসকার (বৃষ্টির জন্য যে নামাজ পড়া হয়) নামাজ আদায় করেন মুসলিস্নরা।
রাজধানীর আফতাবনগরে শায়খ আহমাদুলস্নাহর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত নামাজে শতাধিক মুসলিস্ন অংশ নেন। নামাজ শেষে মুসলিস্নদের নিয়ে খুতবা ও দোয়া করা হয়। এ সময় প্রাকৃতিক দুর্ভোগ থেকে মুক্তিসহ দেশ ও জাতির কল্যাণ প্রার্থনা করা হয়। নামাজ শেষে অনাবৃষ্টি এবং অসহ্য গরম থেকে মুক্তি ও মহান আলস্নাহর রহমত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
তীব্র তাপ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির প্রার্থনায় চুয়াডাঙ্গার মুসলিস্নরা ধর্মীয় বয়ান শেষে দুই রাকাত ইস্তিসকার নামাজ আদায় করেন। এরপর আরবি খুতবার পর আলস্নাহর কাছে হাত তুলে বৃষ্টি প্রার্থনা করেন। এ সময় কান্না করেন অনেকে।
সম্মিলিত ওলামা কল্যাণ পরিষদের আয়োজনে এ নামাজ পরিচালনা করেন সংগঠনটির উপদেষ্টা মাওলানা নূর উদ্দীন ও মোনাজাত করেন মাওলানা বশির আহমেদ।