তীব্র তাপপ্রবাহ

হাসপাতালে রোগীর চাপ, শয্যা সংকট

ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বয়স্করা। সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
তীব্র তাপপ্রবাহে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ধারণক্ষমতার তিনগুণ বেশি রোগী। অধিকাংশ রোগী হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ছবিটি সোমবার তোলা -ফোকাস বাংলা
বৈশাখের শুরু থেকেই দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে সাধারণ মানুষের ত্রাহী অবস্থা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন বয়স্ক ও শিশুরা। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডা কাশি, জ্বর, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। ফলে দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই রোগীর চাপ বেড়েছে। দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এ অবস্থায় সুস্থ থাকতে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। পাশাপাশি বাইরের খোলা খাবার শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁও শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে ৩২ জন নিউমোনিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময় ১৯ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি আছেন ৮৭ জন। চলতি বছরে মোট ভর্তি রোগী ১ হাজার ৮৯৮ জন। সাধারণ জ্বরে ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে ১৮৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। অ্যাজমায় ২৩ জন, স্ক্যাবিস এবং স্কিন ডিজিজে ৬৬ জন এবং ১০৯ জন চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও ডায়রিয়ায় ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন, একজন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, বর্তমানে ভর্তি আছেন পাঁচজন। চলতি বছরে মোট ডায়রিয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৩৮০ জন। পাশাপাশি ঢাকা শিশু হাসপাতালে আউটডোরে ইমার্জেন্সিতে ২৪৮ জন রোগী, মেডিসিন বিভাগে ৬৮১ জন এবং সার্জারি বিভাগে ১৬৪ জনসহ মোট এক হাজার ৯৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। শিশু হাসপাতালে একজন চিকিৎসক বলেন, 'হাসপাতালের বেশির ভাগ সিট ভর্তি হয়ে গেছে। খুব ইমার্জেন্সি কিছু রোগী ভর্তি নিতেই হচ্ছে। যারা গরিব তাদের জন্য আমরা কিছু ব্যবস্থা করছি। অন্যদিকে আর্থিক অবস্থা যাদের ভালো তাদের অন্য কোনো হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছি।' গরমে শিশুদের যত্নের বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'শিশুদের বাইরে রোদে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। ঠান্ডা ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে, পাতলা সাদা সুতি কাপড় বা খালি গায়ে রাখতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফলের শরবত খাওয়ানো যেতে পারে।' তিনি বলেন, 'এ গরমে ঘরের দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে। বেশিক্ষণ কোনো বাবা-মা যেন খোলা জায়গায় খাবার না রাখে, ফ্রিজ থাকলে ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণ করতে হবে। ফ্রিজ থেকে বের করে সেটা আবার গরম করে খাওয়াতে হবে। শিশুদের শরীরের ঘাম মুছে দিতে হবে। প্রয়োজনে দিনে কয়েকবার গোসল করানো যেতে পারে। ঠান্ডা ফ্রিজের পানি বা আইসক্রিম খাওয়া থেকে বাচ্চাদের এ সময় বিরত রাখতে হবে।' যশোরে ধারণ ক্ষমতার তিন গুণ রোগী আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, যশোর জানান ভ্যাপসা গরমে অসুস্থ হয়ে সাধারণ মানুষ যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর ও সর্দিজনিত রোগী। আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু ও বৃদ্ধ। প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ফ্যান ও এসি নষ্ট থাকায় রোগীদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ রোগী থাকায় নতুন রোগীদের ঠাঁই মিলছে মেঝে ও বারান্দায়। বিপুল এই রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড়ে হাসপাতালের পরিবেশও নাজুক হয়ে পড়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা রোগীদের সর্বোচ্চ স্বাস্থসেবা প্রদানে সদা তৎপর রয়েছেন। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, আড়াইশ' শয্যার এই হাসপাতালে সোমবার রোগী ভর্তি রয়েছেন ৬৭৯ জন। এর মধ্যে ঠান্ডা-গরমজনিত সর্দি জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগী রয়েছেন। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ৮৪ জন। তীব্র তাপ প্রবাহের কারণে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি অসুস্থ হয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার, বিভিন্ন চিকিৎসকদের চেম্বার ও আইসিইউ এবং সিসিইউ মিলে মোট ৮৬টি এসি রয়েছে। এর এক-তৃতীয়াংশই নষ্ট। আর মোট ১৭টি ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন কক্ষে ১৬৮টি সিলিং ফ্যান রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি নষ্ট রয়েছে। ফলে গরমে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ফ্যানের অভাবে ভ্যাপসা গরমে রোগীদের জেরবার অবস্থা। যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন জানান, শনিবার রাতে তার মামা রফিকুল ইসলাম গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এখানে রোগীর চাপে ও গরমে অসুস্থ হয়ে আসা রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে রোগীর স্বজন নাজমা আক্তার জানান, প্রচন্ড গরমে জ্বর ও শ্বাসকষ্টের কারণে তার ভাইপো রেজাউল ইসলামকে (৯) শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সিট নেই, ওষুধ নেই। ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। গরমে রোগী-স্বজন সবাই কষ্ট পাচ্ছেন। হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ শাবনুর মির্জা বলেন, ডায়রিয়ার চিকিৎসায় আগে এক মাসে যে ওষুধ লাগত, এখন একদিনেই তা লাগছে। তবে ওষুধ ও স্যালাইনের যা আছে তা দিয়ে আগামী প্রায় দু'সপ্তাহ চলবে। জেলা হাসপাতাল স্বাস্থ্য কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মাদ খোকন হোসেন জানান, হাসপাতালে চিকিৎসকরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে এসি নিয়ে নিজেদের চেম্বারে লাগিয়েছেন। সেই এসি যদি মেডিসিন সার্জারি ও গাইনি ওয়ার্ডে লাগানো যেত তবে রোগীরা এই গরমে উপকৃত হতে পারত। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, 'মূলত গরমের তীব্রতা বাড়ায় এখন ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। সঙ্গে সর্দি-জ্বরসহ তাপপ্রবাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন। যশোর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, কিছু ফ্যান ও এসি নষ্ট থাকায় প্রচন্ড গরমে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এগুলো মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। এছাড়া ১০টি নতুন ফ্যানও লাগানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রচন্ড গরম পড়ায় ডায়রিয়া, সর্দি-জ্বরসহ গরমজনিত রোগে সাধারণ মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিনগুণ রোগী ভর্তি থাকলেও চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। তবে তিনি এই গরমে সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বেশি যত্নশীল হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে বেশি চাপ ময়মনসিংহ বু্যরো জানান, জেলার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েই চলছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও সূর্যকান্ত হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ায় সেবা দিতে কিছু হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। মানুষকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি এই গরমে সুস্থ থাকতে তরল খাবারের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ঠান্ডা, সর্দি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি হচ্ছেন ১২০ জনের মতো শিশু। ৬০ শয্যার ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি রয়েছে প্রায় চার শতাধিক। অপরদিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সূর্যকান্ত (এসকে) হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। অতিরিক্ত রোগীর চাপ বাড়ায় মেঝে ও বারান্দায় শুয়ে সেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের। আর চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীর চাপ সামলিয়ে সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় গত শনিবার দুই বছরের শিশু তানিয়া তাসনিমকে নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন মুক্তাগাছার তাহের উদ্দিন ও আফরোজা আক্তার দম্পত্তি। তাহের উদ্দিন বলেন, অতিরিক্ত গরমের মধ্যে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে সেবা পেলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপের কারণে মেঝেতে শুয়ে সেবা নিতে হচ্ছে। মেয়েটা দ্রম্নত সুস্থ হলেই আলস্নাহর কাছে শুকরিয়া। সোমবার দুপুরে সূর্যকান্ত (এসকে) হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় বেশ কয়েকজন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সেবা নিচ্ছেন। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম (৪০) ও রয়েছেন। তিনি বলেন, গত শনিবার থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। বাসায় স্যালাইন খেয়েছি; তবে সোমবার সকালে হঠাৎ করে শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় দ্রম্নত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। চিকিৎসকরা স্যালাইন দেওয়ায় এখন কিছুটা সুস্থ লাগছে। সূর্যকান্ত (এসকে) হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. প্রজ্ঞানন্দ নাথ বলেন, গরমে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা রোগীর চাপ বেড়েছে। গত মার্চে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ৬০৫ জন রোগী সেবা নিয়েছেন; চলতে মাসে সেবা নিয়েছেন ৬৫৫ জন। তার মানে বলা যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে গরমে বেশি রোগী সেবা নিচ্ছেন। রোগীর চাপ কিছুটা বেশি হলেও আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি; পর্যাপ্ত ওষুধও আমাদের রয়েছে। তবে গরমে মানুষকে চলাফেরায় আরেকটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, অতিরিক্ত গরমে শ্বাসকষ্ট, সর্দি, ঠান্ডা এবং নিউমোনিয়ায় সবচেয়ে বেশি শিশুরা আক্তান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন শতাধিকের ওপরে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ৬০ বেডের স্থলে ভর্তি রয়েছে ৩৭৪ রোগী। ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেঝে এবং বারান্দায় সেবা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা সাধ্য অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করছি।