ঢাকাসহ ৪৫টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে বইছে তাপপ্রবাহ

কমছেই না গরম, আরও ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ঢাকাসহ ৪৫টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। আপাতত তা কমার সম্ভাবনা না থাকায় নতুন হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। দেশের মানুষকে আরও তিনদিন সতর্কতায় থাকতে বলছে প্রতিষ্ঠানটি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। শনিবার তা কয়েক জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহে রূপ পায়। তীব্র গরমের কারণে স্কুল-কলেজে ৭ দিনের ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে মেহেরপুর, সিলেট ও নরসিংদীসহ কয়েক জেলায় হিট স্ট্রোকে বেশ কয়েকজনের মৃতু্যর খবর আসে। হাসপাতালগুলোয় শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোগান্তিতে দিন পার করছেন শ্রমজীবী মানুষ। এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার আবহাওয়া অফিস নতুন এই সতর্কবার্তা দিল। এটি তৃতীয় দফার হিট অ্যালার্ট। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মঙ্গলবার থেকে তাপমাত্রা ফের বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আকাশে মেঘ আছে, তাই আজ (সোমবার) সামান্য কমতে পারে তাপমাত্রা; কালকে (মঙ্গলবার) থেকে আবার বাড়বে। সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে হালকা বৃষ্টি হতে পারে।এ ছাড়া অন্য জায়গায় বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা নেই।' চলমান তাপপ্রবাহ আরও ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, 'বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে এ সময় গরমে অস্বস্তি বাড়তে পারে। সপ্তাহখানেক পর বড় ধরনের ঝড়বৃষ্টি হলে জনজীবনে স্বস্তি মিলতে পারে।' চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় শনিবার; সেদিন যশোরে থার্মোমিটারের পারদ উঠেছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার তাপমাত্রা সামান্য কমলেও তাপপ্রবাহের বিস্তার \হবেড়ে ছড়িয়েছে ৫১ জেলায়। রোববার চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সোমবার সকালে আবহাওয়ার বুলেটিনে বলা হয়েছে, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে রাজশাহী, টাঙ্গাইল, যশোর ও কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে। এর বাইরে মৌলভীবাজার, চাঁদপুর জেলাসহ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং রংপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রোববার সারাদিনই এই ধারা চলতে পারে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, সোমবার খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া যশোর জেলায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি, চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি, সাতক্ষীরায় ৩৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি, মোংলায় ৪০ ডিগ্রি, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪০ ডিগ্রি এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সোমবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা ও ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃদ্ধি হতে পারে। দেশের বাকি অংশে আকাশ আংশিক মেঘলা এবং আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। মঙ্গল ও বুধবার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। ভোগান্তিতে শ্রমজীবী মানুষ এদিকে তীব্র গরমে ভোগান্তিতে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। তবুও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই কাঠফাটা রোদের মধ্যেই তাদের বাহিরে বের হয় কাজের সন্ধানে। ঢাকার রিকশাচালক শফিকুল ইসলাম (৫০) বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকায় খুব গরম বেড়েছে। তবে এবারের মতো গরম আর পড়েনি। রাস্তায় বের হলেই শরীরটা রোদে পুড়ে যায়। কিন্তু আমাদের তো আর ঘরে বসে থাকার উপায় নাই! গরম পড়লেও রিকশা নিয়ে বাইরে বের হতে হয়। তিনি বলেন, আগে ৮ ঘণ্টা রিকশা চালাতে পারলে এখন চালাতে হয় ৪ ঘণ্টা। বাকি ৪ ঘণ্টা বিশ্রাম করতে হয়। নইলে শরীরে শক্তি পাই না। গরমের কারণে অন্য সময়ের তুলনায় ১০ টাকা হয়তো বেশি নেওয়া যায় যাত্রীদের কাছ থেকে। কিন্তু সেটা থাকে না। বরং দুই-তিনবার যাত্রী বহন করলে একটু ঠান্ডা শরবত খেতে হয়। এতে চলে যায় ২০-৩০ টাকার বেশি। রিকশাচালক মোমিন বলেন, ধানমন্ডি থেকে মতিঝিল যেতে পথে তিনবার দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় তো বিশ্রাম নেওয়ার মতো গাছ পর্যন্ত নেই। শরবত খেতে হয়েছে দুই বার। আমাদের মতো গরিবদের কষ্ট সয়ে গেছে। গরম হোক বা শীত, আমাদের বসে থাকার অবসর নেই। পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে নডুলসের প্যাকেট নিয়ে মিরপুরে একটি দোকানে যাচ্ছিলেন ভ্যানচালক আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, পুরান ঢাকা থেকে কারওয়ান বাজার মোড় পর্যন্ত আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগছে। পথে ১০-১২ বার দাঁড়াতে হয়েছে বিশ্রামের জন্য। এমন গরম না থাকলে হয়তো দুইবার দাঁড়ালেই এখানে চলে আসতে পারতাম। এই গরমে মাল টানতে খুবই কষ্ট হয়। কিন্তু এই কাজ ছাড়া আর তো কিছু করার নেই। এই কাজ না করলে খাব কী? আগে দিনে দু-তিন জায়গায় পণ্য আনা-নেওয়া করতাম। কিন্তু এখন একবার নিয়ে আর পারি না। শরীর সায় দেয় না। আবার রাস্তায় গাছও নেই যে, একটু শান্তিতে বিশ্রাম নেব। চায়ের দোকানই ভরসা। খামারবাড়ী পার হলে হয়তো একটু গাছের ছায়ায় যেতে পারব। গরমের কারণে যাত্রী কমেছে রাইড শেয়ার করা মোটর সাইকেল চালকদেরও। সাইফুল ইসলাম নামে এক রাইডার বলেন, গরমের কারণে দিনের বেলা যাত্রীরা মোটর সাইকেলে উঠতে চায় না। কারণ যানজটে পড়লে রোদে খুবই খারাপ লাগে। রাতে হয়তো কিছুটা যাত্রী পাওয়া যায়। ফলে আগে যেখানে কয়েক ঘণ্টা রাইড শেয়ার করলেই এক হাজার টাকা আয় হতো, সেখানে এখন সারাদিনেও এক হাজার টাকা আয় হয় না। একই অবস্থা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদেরও। হেলাল উদ্দিন নামে এক চালক বলেন, সিএনজিতে অনেক তাপ লাগে। যার কারণে মানুষ উঠে হাঁসফাঁস করে। আর তাছাড়া রাস্তায় মানুষও কম। আগে যে সময় ১০ বার যাত্রী পরিবহণ করতাম, সেখানে এখন ৬-৭ বার করতে হয়। একই অবস্থা বাসচালক, লেগুনা চালকসহ সব শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের সব মানুষের। তাপদাহ এসব মানুষের কষ্টের জীবনকে করে তুলেছে আরও কষ্টদায়ক। রিকশা চালকের মৃতু্য এদিকে প্রচন্ড গরমের মধ্যে রিকশা চালানোর সময় অসুস্থ হয়ে আব্দুল আউয়াল (৪৫) নামে এক রিকশাচালকের মৃতু্য হয়েছে। সোমবার বিকালে ঢাকা নার্সিং কলেজের পেছনের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বিকাল সাড়ে ৪টায় মৃত ঘোষণা করেন। শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুমন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আব্দুল আউয়াল রিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। পরে তাকে দ্রম্নত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আমাদের ধারণা অতিরিক্ত গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃতু্য হয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃতু্যর সঠিক কারণ জানা যাবে। মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। নিহত আব্দুল আউয়াল হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার সিংহগ্রামের আজম আলীর ছেলে। তিনি নারায়ণগঞ্জে বসবাস করে রাজধানীর শনির আখড়া ও আশপাশের এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।