ন্যাপ এক্সপো উদ্বোধন

যুদ্ধে নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে অর্থ ব্যয় করুন : প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ন্যাপ এক্সপো-২০২৪ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন -ফোকাস বাংলা
যুদ্ধে অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকা জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় খরচ করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে 'ন্যাশনাল অ্যাডাপশন পস্ন্যান (ন্যাপ) এক্সপো-২০২৪'র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যুদ্ধে অস্ত্র এবং অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে যদি ব্যয় করা হতো তাহলে বিশ্বটা রক্ষা পেত।' জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার সেই ১৯৭২ সালেই 'বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন' মন্তব্য করে তার মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করেছিলেন। দেশের উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই ন্যাশনাল হারবেরিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জনে তিনি বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।' প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই নিজস্ব সম্পদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে 'বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড' প্রতিষ্ঠা করেছি। এর আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৯৬৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।' সামুদ্রিক বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, উপকূলীয় বনায়ন ইত্যাদি কর্মসূচিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার তথ্য অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং গত বছরের ঘূর্ণিঝড় 'মোখা'র ক্ষয়ক্ষতির পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ওই সময়ে (১৯৭০) প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃতু্য হয়েছিল। কিন্তু মোখায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।' প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত দেড় দশকে পার্বত্য ও শাল বনাঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৪৮ হেক্টর এলাকায় বৃক্ষরোপণসহ ৮৯ হাজার ৮৫৩ হেক্টর উপকূলীয় বন সৃজন করা হয়েছে। সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর জন্য কক্সবাজার জেলায় আমরা বিশ্বের বৃহত্তম 'খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প' নির্মাণ করেছি। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমিহীন, গৃহহীন, সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে জমিসহ ঘর প্রদান করেছি এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৪২ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন করেছি।' প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশের কম হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে 'বাংলাদেশ অন্যতম'। তিনি আরও বলেন, 'অব্যাহত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২ থেকে ১৭ শতাংশ, এ শতাব্দীর শেষ দিকে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।' বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি (প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায়) ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমিত রাখতে উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, 'গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশনস (আইএনডিসি)) প্রণয়ন করে এবং ২০২১ সালে তা হালনাগাদ করে ইউএনএফসিসিতে জমা দেয়। এতে আমরা শর্তহীন ৬ দশমিক ৭৩ এবং শর্তযুক্ত ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস \হনিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।' তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি যাতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস পায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন এবং গ্রামাঞ্চলে ৪৫ লাখের বেশি উন্নত চুলা বিতরণ করা হয়েছে।' গত বছরে প্রণয়ন করা 'মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি পস্ন্যান' (এমসিপিপি) এর কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, 'এমসিপিপিতে অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণ, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান ও সমাজের সবার অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।' আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, 'বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) ২০২২-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এটি ইউএনএফসিসিতে দাখিল করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় আমরা ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিযুক্ত এলাকায় ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছি।' এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় ২৩০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন জানিয়ে এই অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা নিতে বিশ্বের ধনী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, 'উন্নত দেশগুলো ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অধিক ভূমিকা রেখে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি থাকাকালে অভিযোজন এবং প্রশমন কার্যক্রমে উন্নত দেশের প্রতিশ্রম্নত ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর দেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য বার বার আহ্বান জানিয়েছি। আমার প্রত্যাশা, উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রম্নতি রক্ষা করবে।' শেখ হাসিনা বলেন, 'কপ-২৬ এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোর ২০২৫ সালের মধ্যে অভিযোজন-অর্থায়ন ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ করার কথা। এটি বাস্তবায়নে আমি ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই। যেসব দেশ ইতোমধ্যে ন্যাপ প্রণয়ন করেছে, তারা যেন ন্যাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউএনএফসিসিসহ অন্যান্য সব উৎস থেকে সহজে এবং দ্রম্নততার সঙ্গে আর্থিক সহযোগিতা লাভ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।' প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাসে অভিযোজন ও প্রশমন উভয় ক্ষেত্রে উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইউএনএফসিসির 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' তহবিল থাকে অর্থপ্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সহিষ্ণুতা শক্তিশালী করা এবং ঝুঁকি হ্রাসে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। প্রথমত, প্রধান কার্বন-নির্গমনকারী দেশগুলিকে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে তাদের নির্গমন হ্রাস করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু তহবিলে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রম্নতি উন্নত দেশগুলোর পূরণ করতে হবে। অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে তা সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। তৃতীয়ত, উন্নত দেশগুলিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রযুক্তি স্থানান্তরের পাশাপাশি সবচেয়ে কার্যকর জ্বালানি সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। চতুর্থত, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের সময় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলো তাদের ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পঞ্চমত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী-ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচু্যত মানুষদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সব দেশকে ভাগ করে নিতে হবে। সবশেষে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী সবার সঙ্গে কাজ করতে হবে প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ সবসময়ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে 'বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ- বিসিডিপি' গঠন করা হয়েছে।' 'মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি পস্ন্যান', 'ন্যাশনাল অ্যাডাপশন পস্ন্যান', 'ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন' এবং বাংলাদেশের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে বিসিডিপি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।