বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিদু্যতের ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে। গ্রীষ্মের খরতাপের সাথে বিদু্যতের আসা-যাওয়ায় মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নগরীতে এলাকাভেদে দিনে ও রাতে মিলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টাও বিদু্যৎ থাকছে না। বিদু্যৎ না থাকায় বাসা-বাড়িতে ওয়াসার পানি সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। এতে পানির সংকটে পড়েছেন নগরবাসী। সব মিলিয়ে প্রচন্ড গরমে যেন জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর কালুরঘাট সংলগ্ন বোয়ালখালী উপজেলায় বিদু্যতের লোডশেডিং চলাকালে ভ্যাপসা গরমে ছয় মাস বয়সি এক কন্যা শিশুর মৃতু্য হয়েছে। বেড়েছে হিট স্ট্রোকও। এমন রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে।
নগরবাসীর তথ্যমতে, গত রমজানে সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ সরবরাহের কথা বললেও মূলত লোডশেডিং শুরু হয় তখন থেকে। রোজায় সেহরির সময়, ইফতারির সময়, নামাজের সময় বিদু্যৎ না পেয়ে ক্ষোভ ঝেরেছেন অনেকেই। সেই থেকে একই অবস্থা বিরাজ করছে এখনো। বরং গরমের সাথে পালস্না দিয়ে এলাকাভেদে আরও বেড়েছে বিদু্যতের লোডশেডিং।
নগরবাসীর অভিযোগ, বিদু্যতের লোডশেডিংয়েও করা হচ্ছে বৈষম্য। এমপি-মন্ত্রী, পুলিশ, বিচারক ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেসব এলাকায় থাকেন, সেখানে অন্য এলাকার চেয়ে বিদু্যতের লোডশেডিং কম। এর মধ্যে বিদু্যতের লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি করা হয় নগরীর চান্দগাঁও থানার বিভিন্ন এলাকায়।
চান্দগাঁও থানার বেপারিপাড়া এলাকার এক বাসিন্দা জানান, এ এলাকায় দিনে ও রাতে মিলে পাঁচ ঘণ্টা বিদু্যৎ থাকে না। একবার বিদু্যৎ গেলে আসে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর। ফলে এই এলাকার জনজীবন মারাত্মকভাবে বিপর্যন্ত। একইভাবে মুরগির খামার, গরুর খামারসহ বিভিন্ন কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
জানা যায়, বিদু্যৎ লোডশেডিংয়ে নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, ফরিদের পাড়া, সমশের পাড়া, বহদ্দারহাট এলাকাও বিপর্যস্ত।
এ বিষয়ে কালুরঘাট বিদু্যৎ বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী গিয়াস ইবনে আলম বলেন, গরমের কারণে
বিদু্যতের চাহিদা বেড়েছে। সে তুলনায় বিদু্যৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। ফলে বিদু্যতের লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।
নগরীর চাঁদগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, নগরীর অভিজাত নাসিরাবাদ আবসিক এলাকা, মৌসুমি আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ এলাকায় বিদু্যতের লোডশেডিং অনেকটা কম। তবে শহরের চেয়ে ভয়াবহ লোডশেডিং হচ্ছে পলস্নীবিদু্যৎ সমিতির আওতাধীন এলাকায়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শতভাগ বিদু্যতায়নের পরেও ভয়াবহ এই লোডশেডিং মেনে নেওয়া যায় না। চট্টগ্রামের সব বিদু্যৎকেন্দ্রে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন হয়। অথচ গ্রিড থেকে দেওয়া হচ্ছে অর্ধেক। এটা চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ।
নগরীর ষোলশহর এলাকার গৃহিণী আবিদা সুলতানা বলেন, রোববার সকাল ৯টায় বিদু্যৎ যায়। এক ঘণ্টা পর এসে আবার বেলা ১১টায় চলে গেছে। আধা ঘণ্টা বিদু্যৎ ছিল। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় আসে। আবার বিকাল ৩টায় যায়, আসে বিকাল ৫টায়। রাত ৮টায় যায়, সাড়ে ৯টায় আসে। কয়েক দিন ধরে এভাবে বিদু্যৎ আসা-যাওয়া করছে। এতে ছোট বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে।
নগরীর শুলকবহর এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, রমজানের শুরু থেকে ওয়াসার পানি নিয়ে কষ্টে আছি। এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে লোডশেডিং। সারা দিনে ছয় থেকে আটবার লোডশেডিং হচ্ছে। মধ্যরাতেও লোডশেডিং হওয়ায় প্রচন্ড গরমে বাসিন্দারা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সারারাত জেগে থাকতে হয়। এর আগে গরমের কারণে বোয়ালখালী উপজেলায় আমার নিকটাত্মীয়ের ছয় মাস বয়সি এক কন্যা শিশুর মৃতু্য হয়েছে।
বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের (বিতরণ) তথ্যেও মিল পাওয়া যায় বিদু্যতের লোডশেডিংয়ের। তাদের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে নগরীর, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও কল্পলোক আবাসিক এলাকায়। এলাকাগুলো নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ জনপদগুলোর একটি।
এর বাইরে পাথরঘাটা, স্টেডিয়াম, ষোলশহর, মাদারবাড়ী, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাহাড়তলী, খুলশী, রামপুর, নিউমুরিং বিদু্যৎ সরবরাহ কেন্দ্রগুলো পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে। শহরের বাইরে বিদু্যৎ সরবরাহ ইউনিট ফৌজদারহাট, হাটহাজারী, মোহরা, বাড়বকুন্ড, সন্দ্বীপ, পটিয়া, সাতকানিয়া, দোহাজারীতে তিন-পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদু্যৎ বিতরণ বিভাগ (চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চল)।
তবে বিদু্যৎ বিভাগের এই বিবরণের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই বলছেন ভোক্তারা।
রোববার দুপুরে নগরের টেরি বাজারে মাইশা ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মো. আলাউদ্দিন বলেন, আমার এই দোকান থান কাপড় ও থ্রি-পিচের জন্য বিখ্যাত। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে এখন দোকানদারি করতেই কষ্ট হচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই থাকে না বিদু্যৎ। বিকল্প হিসেবে লাগানো হয় জেনারেটর। কিন্তু বিদু্যতের চাপ বেড়ে যাওয়া তা নষ্টের পথে।
বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সিস্টেম কন্ট্রোল সূত্র জানিয়েছে, শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে পিক আওয়ারে চট্টগ্রামে বিদু্যতের চাহিদা ছিল এক হাজার ২৮০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া গেছে ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে ওই সময়ে চট্টগ্রামে লোডশেডিং হয়েছে ৩৮০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট। এছাড়া সারা দিনে কমবেশি ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে।
বিদু্যৎ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম। তাই গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদু্যৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৮ কোটি ঘনফুট। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিদু্যৎ বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এম রেজাউল করিম বলেন, বিদু্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা নাজেহাল অবস্থায় আছি। জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদু্যৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। রোববার আমাদের চাহিদা ছিল সাড়ে ১২শ' মেগাওয়াটের বেশি, কিন্তু আমরা পেয়েছি ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে বিভিন্ন এলাকায় রেশনিং করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে কয়েকটি পাওয়ার পস্ন্যান্ট বন্ধ থাকার কারণে বিদু্যতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাউজান তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্র, এখানকার ৪২০ মেগাওয়াটের ২টি বিদু্যৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। পটিয়ার শিকলবাহা ২২৫ মেগওয়াট বিদু্যৎ কেন্দ্র এবং ডুয়েল-ফুয়েল পদ্ধতির ১৫০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ কেন্দ্রটিও বন্ধ।
এছাড়া হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার পস্ন্যান্ট এবং সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ডে ২৪ মেগাওয়াটের রিজেন্ট পাওয়ার পস্ন্যান্ট বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ ১১০ মেগাওয়াটের এনার্জি প্যাক-এ। অপরদিকে পটিয়ায় ১১৬ মেগাওয়াটের আনলিমা পাওয়ার পস্ন্যান্ট থেকে ২১ মেগাওয়াট, শিকলবাহা জুডিয়াক পাওয়ার পস্ন্যান্টে ৫৪ মেগাওয়াট, ১০৫ মেগাওয়াটের বারাকা পাওয়ার পস্ন্যান্ট থেকে ৮৫ মেগাওয়াট, ৫০ মেগাওয়াটের বারাকা পাওয়ার পস্ন্যান্ট থেকে ১২ মেগাওয়াট, ১১০ মেগাওয়াটের বারাকা কর্ণফুলী বিদু্যৎ কেন্দ্র থেকে ৩৩ মেগাওয়াট, কর্ণফুলীর ৩০০ মেগাওয়াট জুলধা বিদু্যৎ কেন্দ্র থেকে ১৭৭ মেগাওয়াট, দোহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার পস্ন্যান্টে ৭৯ মেগাওয়াট, আনোয়ারার ৩০০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার পস্ন্যান্ট থেকে ১৩০ মেগাওয়াট, ৫০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার পস্ন্যান্ট থেকে ১৭ মেগাওয়াট, রাউজানে ২৬ মেগাওয়াটের আরপিসিএল পাওয়ার পস্ন্যান্ট থেকে ১২ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন হচ্ছে।