চট্টগ্রামে ভ্যাপসা গরমে ওষ্ঠাগতপ্রাণ। এতে জ্বর, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ভ্যাপসা গরমে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিও। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মকভাবে।
হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ও ঝুঁকিতে থাকা রোগীরা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলে জানান চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. মো. শাহেদ উদ্দিন। তিনি বলেন, সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও তীব্র দাবদাহে দিশেহারা মানুষ। জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে।
শুক্রবার চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে হিটস্ট্রোকের রোগী আসার পর তাদের ডায়াগনোসিস না করে ১৩, ১৪, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই জ্বর ভাইরাল ফিভার নাকি হিটস্ট্রোক হয়েছে, তা জানতে ডায়াগনোসিস করতেই পুরো দেড় থেকে দু'দিন চলে যাচ্ছে।
এমন অনেক রোগীর দেখা মিলেছে তিনটি ওয়ার্ডে। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বাসিন্দা মো. ইউসুফ। তিনি বলেন, হঠাৎ তার জ্বর ওঠে। পরে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নিয়ে গেলে তাকে শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানো হয়। ইউসুফ গরমজনিত শকে আক্রান্ত বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়।
চট্টগ্রামের প্রধান আবহাওয়া কার্যালয়ের পূর্বাভাস কর্মকর্তা এম এইচ এম মোছাদ্দেক জানান, শুক্রবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী পাঁচ দিনের আবহাওয়াতেও উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই জানিয়ে হিট অ্যালার্ট তথা তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে অধিদপ্তর।
এই অবস্থায় চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুর রব তীব্র গরমের মধ্যে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি নিয়ে নগরবাসীকে সতর্ক করে বলেছেন, তাপপ্রবাহের সময়টাতে সুতি কিংবা পাতলা কাপড় ছাড়া আর কিছু পরা যাবে না। রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, হিটস্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। পানি খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে, ধীরে ধীরে পান করতে হবে, অল্প অল্প করে সারাদিনে, একসঙ্গে না।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়াও হিট স্ট্রোক নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে রোদে গেলে হিট স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। সে জন্য মাথায় ছাতা ও পর্যাপ্ত পানীয় জল বা যেকোনো বিশুদ্ধ তরল পান করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা রাখতে হবে, বিশেষ করে যাত্রী ছাউনির পাশে। গণপরিবহণের ছাদ তাপ নিরোধী করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে বিআরটিএ।
চমেক হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. অজয় ঘোষ বলেন, গরমে হিট স্ট্রোকের আশঙ্কাটা বাড়ছেই। যাদের বয়স ৫০ থেকে ৫৫ বছর বা তার বেশি, তারা যেন রোদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বাইরে না থাকেন। তারা সকাল ৯টার আগে এবং বিকাল ৫টার পরে বাইরে বের হয়ে যেন তাদের প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে নেন, এটা আমরা জনসাধারণকে বলছি। মাঝখানের সময়টা যেন তারা বাইরে না থাকেন, সেটাই ভালো হবে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক ডা. বিদু্যৎ বড়ুয়া বলেন, গরমে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এ জন্য দরকার সকালের দিকে বাইরের কাজ সেরে নেওয়া। সকাল ১০টা-১১টার পর থেকে বিকাল ২টা-৩টা পর্যন্ত তাপমাত্রা খুব প্রকট থাকে। সে সময় পারতপক্ষে বাইরে বের না হওয়া, এ সময়ের আগে কিংবা পরে বের হয়ে কাজগুলো সেরে নিতে পারলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। এছাড়া ঠান্ডা জায়গায় থাকতে হবে। ঘরে ভেন্টিলেশন থাকতে হবে, যেন বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজের (বিআইটিআইডি) সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাকিল আহমদ বলেন, সংক্রামক ব্যাধিগুলো একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। এ সময় প্রচুর ভাইরাল ইনফেকশন হয়। যিনি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি বাইরে বের হবেন না পারতপক্ষে। কাজের জন্য যাদের বের হতেই হয়, তারা কিছু সচেতনতা অবলম্বন করতে পারেন।
ডা. শাকিল বলেন, কাশি এলে টিসু্যর মধ্যে কাশি দেবেন অথবা কিছু না পেলে হাতের মধ্যে কাশি দেবেন, যেন অন্য মানুষের গায়ে না পড়ে। খোলা জায়গায় যেন কাশি না দেওয়া হয় এবং সর্দি-কাশি থাকলে ভিড় অ্যাভয়েড করলে ভালো হয়। কোথাও বসলে তিনি যেন একটা চেয়ার গ্যাপ দিয়ে বসেন অথবা পাশের মানুষের সঙ্গে উনার যেন তিন ফুট দূরত্ব থাকে। এ তিন ফুট দূরত্বটা নিশ্চিত করতে পারলেই কিন্তু পাশের মানুষটি নিরাপদ থাকবেন।
গরম যতই জেঁকে বসছে, ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিআইটিআইডির সহযোগী অধ্যাপক শাকিল আহমদ। তিনি বলেন, এ সময়টাতে ডেঙ্গুর প্রভাব কিন্তু খুব বেড়ে যায়। অলরেডি ডেঙ্গুর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। এই যে অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, সেই পানি কিন্তু জমে থাকে। এর থেকে ডেঙ্গুটা বাড়বে। এখনই সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। বাড়ির আশপাশ, ডাবের খোসা, খালি পাত্র এগুলোতে যেন পানি জমতে না পারে। ছাদে টব থাকলে সেখানে যেন পানি জমে না থাকে। কোথাও জমা পানি থাকলে পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।