ঈদযাত্রার চেয়েও ফেরার পথে সড়ক-মহাসড়ক আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি- দু'টিই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাস ও মোটর সাইকেলে ঘটে বেশি দুর্ঘটনা। ঈদের আগে-পরের ১৫ দিনের সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি নিয়ে করা এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে যানজটের কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের গতি কম থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও বেশি থাকে। তাই অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় কম নামে। এ জন্য যাত্রী পরিবহণ বেশি হলেও দুর্ঘটনার হার কম। কিন্তু ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক অনেকটাই ফাঁকা থাকার কারণে চালকেরা ইচ্ছেমতো গাড়ির গতি তোলেন। দ্রম্নত যাত্রী নামিয়ে নতুন ট্রিপ ধরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ, চালকের ক্লান্তি। কারণ ঈদের আগে থেকে একটানা গাড়ি চালান চালকেরা। ফলে তারা বিশ্রামের সুযোগ পান না। চালক-মালিক দুই পক্ষই বাড়তি আয়ের আশায় ঈদের আগে-পরে ১৫ দিন বিরামহীন বাস চালিয়ে থাকেন।
ঈদ পরবর্তী সময়ে হাইওয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম থাকার সুযোগে লোকাল রুটের লক্কর-ঝক্কর যানবাহন নিয়ে অদক্ষ চালকরাও যাত্রী পরিবহণে নামেন। এছাড়া ট্রাক পিকআপসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী পরিবহণ করা হয়। ধারণ ক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি মালামাল নিয়ে যানবাহন চলাচল করে। ফলে অদক্ষ চালকরা প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। যা সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ১৪ দিনে (২০২৩ সালের ১৬ থেকে ২৯ এপ্রিল) দেশে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত হন। আহত হন কমপক্ষে ৪৫৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায়। এর আগের বছর ঈদুল ফিতরের আগে-পরের ১৪ দিনে (২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে) ২৮৩টি দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। আহত হয়েছিলেন অন্তত দেড় হাজার মানুষ। এর মধ্যে ১২৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জন নিহত হন, যা মোট নিহত মানুষের ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঈদের আগে ঘরমুখো মানুষের যাত্রাপথে যে সংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, ফিরতি পথে তার প্রায় দ্বিগুণ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় মৃতু্যর হারও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া বেশির ভাগ যানবাহনই ফিটনেসবিহীন এবং অদক্ষ চালক এসব গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ঈদ পরবর্তী সড়ক-মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও কম।
এদিকে ঈদের আগে দুর্ঘটনা কম হলেও ঈদের পর ফিরতি যাত্রায় দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার বিষয়টি খোদ সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'ঈদের ফিরতি যাত্রায় আমাদের নজর কম থাকে। তাই এ সময় দুর্ঘটনা-প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। এটিতে আমাদের নজর রাখা দরকার।'
এআরআই ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের আগে-পরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য তুলে ধরে জানায়, ওই সময় ১৭২টি দুর্ঘটনায় ১৫৪ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে ঈদের আগের সাত দিনে ৫০টি দুর্ঘটনা ঘটে। আর ঈদের দিন থেকে পরের আট দিনে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১২২টি। ঈদের আগে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৭২ জনের। পরের আট দিনে প্রাণ হারান দ্বিগুণ ১৪৪ জন।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, প্রতি ঈদের আগে-পরের সময়টাতে গড়ে প্রাণ হারান ৩০০ জন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ঈদের আগে এবং দুই-তৃতীয়াংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ঈদ-পরবর্তী ফিরতি যাত্রাপথে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিরাপদ রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ তৎপরতা দেখা গেলেও ধর্মীয় এ উৎসব পরবর্তী সময়ে তাতে যথেষ্ট ঢিলেমিরও প্রমাণ পেয়েছে তারা। এছাড়াও ঈদের আগে-পরে সাত দিন মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ থাকার কথা থাকলেও তা যথাযথভাবে নজরদারি করা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর নেতারা। যদিও হাইওয়ে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন।
সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, একই সড়কে ছোট-বড় এবং কম ও বেশি গতির যানবাহন চলাচল করে। ঈদ পরবর্তী সময়ে ফাঁকা সড়কে বেশি গতির যানবাহনগুলো কম গতির যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে। মহাসড়কে দূরপালস্নার পথের বাস ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলে। গড়ে প্রতি এক মিনিট পরপর এসব বাস অন্য যানকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওভারটেক করার চেষ্টা করে। তাই গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ না হলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।
পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটরযান আইন অনুসারে, একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টা যানবাহন চালাতে পারেন। এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা চালানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চালকের সংকটের কারণে এটা মানা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালকের বিশ্রাম ও কর্মঘণ্টা মানার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। তবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এই নির্দেশনা পরিবহণ মালিক-শ্রমিকেরা মানছেন না।
সড়ক পরিবহণ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল ফিতরের দিন থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল (১১ থেকে ১৮ এপ্রিল) পর্যন্ত বেসরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। এর মধ্যে মঙ্গলবার ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১৫ জন এবং বুধবার ঝালকাঠিতে ট্রাক-মাইক্রোবাস ও অটোরিকশার ত্রিমুখী সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃতু্যর ঘটনা উলেস্নখযোগ্য। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটছে মহাসড়কে অবৈধভাবে চলাচলকারী অটোরিকশা, ইজিবাইক, নসিমন-করিমনের মতো যানবাহনের কারণে। অপর বড় একটি অংশ হয়েছে বাস, ট্রাক এবং কাভার্ডভ্যানের অদক্ষ চালকের কারণে। এছাড়া ঘাতক যানবাহনের একটি বড় অংশই ফিটনেসবিহীন।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণাতে দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় একটি কারণ বেপরোয়াভাবে গতিতে চালনা, বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অদক্ষ চালক।
ঈদ-পরবর্তী সড়ক দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাইওয়ে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট তৎপর হলে এ সংখ্যা হয়তো অর্ধেকে নেমে আসত। তাদের ভাষ্য, প্রশাসন এ ব্যাপারে যে দাবিই করুক না কেন, তাদের তৎপরতার যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে তা দুর্ঘটনার ধরন খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও হাইওয়ে পুলিশের যথাযথ নজরদারি থাকলে ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়কে চলাচল করার সুযোগ পেত না। অদক্ষ কেউ চালকের আসনে বসার সাহস পেতেন না।
এদিক গণপরিবহণের দক্ষ চালকরাও অনেকেই এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তাদের ভাষ্য, মালিকরাও চেষ্টা করে, কত কম খরচ করে, পরিবহণ শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে বেশি লাভ করা যায়। তারা যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর দেন না। দক্ষ চালকের পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় তারা কম মজুরিতে অদক্ষ চালক নিয়োগ দেন। আর ঈদ-পরবর্তী সময়েই এ ধরনের প্রতিযোগিতা বেশি হয়। কেননা ঈদের আগে ৭ থেকে ৮ দিন টানা গাড়ি চালিয়ে দক্ষ চালকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাই তাদের অনেকে ঈদ-পরবর্তী সময়ে গাড়ি চালাতে চান না।
ঢাকা-বেনাপোল রুটের গাড়িচালক মোকাম্মেল হোসেন জানান, ঈদের আগের তিন দিন-তিন রাত না ঘুমিয়েই তিনি গাড়ি চালিয়েছেন। তবে গাড়ি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর যাত্রী নামিয়ে নতুন যাত্রী তোলার সময়টুকু কাউন্টারের সোফায় এক-দেড় ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েছেন। তাই ঈদের দিন থেকে বিশ্রামে ছিলেন। দুই দিন পর কর্মস্থলে এসে জেনেছেন, তার সহকারী গাড়ি নিয়ে একই রুটে যাত্রী পরিবহণ করছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে মালিককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছেন।
চালক মোকাম্মেলের দাবি, এ ধরনের ঘটনা পরিবহণ সেক্টরে অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে কেউ আপত্তি তুললে গাড়ির মালিকরা ওইসব শ্রমিককে বয়টক করছেন। তাই চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে চালকরা ক্লান্তি ভুলে টানা গাড়ি চালাচ্ছেন। কেউবা স্বেচ্ছায় অদক্ষ সহকারীর হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দিচ্ছেন।
ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটের গাড়িচালক খোকন মিয়া বলেন, ঈদের পর শুধু ফিরতি যাত্রাতেই প্যাসেঞ্জার মেলে। যাওয়ার সময় খুবই কম যাত্রী পাওয়া যায়। এ কারণে ফিরতি পথের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ থাকে। তাই এ সময় দ্রম্নত গন্তব্যে পৌঁছে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে জেলা শহরে ফেরার বেশি তাগিদ থাকে। এ কারণে চালকরা অনেকে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান।
তবে চালক খোকন মিয়ার দাবি, শুধু চালকদের অদক্ষতা ও বেপরোয়া গতিই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ নয়। তার ভাষ্য, কম গতির থ্রি-হুইলারসহ ছোট যানবাহন ও মোটর সাইকেল হাইওয়ে থেকে তুলে দেওয়া হলে এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করা গেলে বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ যানবাহনের মালিক ফিটনেসের তোয়াক্কা করেন না। টাকা-পয়সা দিয়েও অনেক সময় তারা ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় করে নেন। যা দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।